তেমনি স্রেফ আঙ্গিকগত বিদ্রোহেও শিল্পগত সৌন্দর্যের থাকে না কোনো পরিচয়। তা দু দিনেই আসে ফিকে হয়ে। এককালে বাংলা সাহিত্যের ত্রিশের কিছু সংখ্যক কবি আর লেখককে ‘বিদ্রোহী’ মনে করা হতো, কিন্তু সে বিদ্রোহও যতখানি ভাবগত ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল ভঙ্গিগত–ফলে তা সৃষ্টিশীল ফসলের দিক দিয়ে শোচনীয়ভাবেই হয়েছে ব্যর্থ। বাংলা সাহিত্যের ঐ যুগে এমন কোনো সাহিত্যকর্ম সৃষ্ট হয় নি যা শিল্পোত্তীর্ণের দাবি রাখে।
শুধু প্রচলিত ধারা কি গতানুগতিকতার বিরোধিতা কিংবা সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র বা পারিপার্শ্বিকের সমালোচনা কি তার নিখুঁত রূপায়ণ কখনো সাহিত্যে-শিল্পে বিদ্রোহ বলে স্থান পেতে পারে না যদি তা সত্যিকার সৃষ্টিতে রূপায়িত হয়। সৃষ্টির জন্যে যে গ্রহণশীলতা, সহনশীলতা আর ঔদার্য প্রয়োজন তা ‘প্রতিবাদমুখী’ মনে অনেক সময় আশ্রয় পারে না। তেমন মন কখনো যথার্থ সৃষ্টিশীল হতে পারে না এ কারণে। আমাদের সমাজের হত-শ্রী অবস্থা দেখে আমরা অনেকেই অনেক সময় বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদমুখর হয়েছি। আমাদের বহু রচনায় তার প্রতিফলন ঘটেছে। এ সবকেও। স্রেফ প্রতিবাদী’ সাহিত্যই বলা যায়। যথার্থ ‘বিদ্রোহী সাহিত্য’ এ নয়। আমরা জীবনে। যা মেনে নিয়েছি অনেক সময় তারই প্রতিবাদ করেছি কলমের মুখে। ফলে আমরা খটি হতে পারি নি, সাহিত্য-কর্মে হতে পারি নি ‘সত্য’। ত্রিশের লেখকদেরও এ দশা ঘটেছিল। এ হয়তো প্রাচ্য সমাজ-ব্যবস্থা আর তাতে লালিত মনেরই এক স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। আমাদের লেখকদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এক স্ববিরোধী সমাজেই বাস করতে হয়। এ সমাজকে অস্বীকার করা আজ কোনো শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব নয়। এর পেছনে বহু কারণ রয়েছে। বিশ্বের তাবৎ দেশের সঙ্গে আমাদের ভাবের আদান প্রদান এখন দ্রুত ও সহজতর হয়েছে। যে কোনো ভাবতরঙ্গ এখন আমাদের শিল্পীদের মনেও হানা দেয়, নব-চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে তাদেরও। কিন্তু শিল্পে এর অভিব্যক্তি এখন দু কারণে অসম্ভব। এক, সমাজ তথাকথিত ঐতিহ্য-বিরোধী রচনার প্রতি মোটেও সহিষ্ণু নয়। বলা বাহুল্য, এ সামাজিক সহিষ্ণুতাটুকু শিল্পের জন্য অত্যাবশ্যক–সমজদারির কথা নাই বা বললাম। দ্বিতীয়ত, গাছের মতো যে কোনো ভাব-চেতনাও একটা মাটি বা পরিবেশকে অবলম্বন করেই গড়ে ওঠে, সেখান থেকে রস আর খাদ্য গ্রহণ করেই ওঠে বেঁচে, হয় পল্লবিত। কাজেই বিদেশের যে কোন ভাবতরঙ্গ আমাদের মনে দোলা দেওয়া খুবই স্বাভাবিক বটে কিন্তু তা আমাদের শিল্পকর্মের সহজাত অবলম্বন হতে পারে বলে আমার মনে হয় না। দেখা গেছে, যতবারই এ চেষ্টা হয়েছে। ততবারই তা হয়েছে ব্যর্থ।
লেখকের ব্যবহারিক জীবন আর তাঁর শিল্প-সত্তায় যে কিছুটা পার্থক্য নেই তা নয়–তা হলেও তার ভাববস্তু যদি তার কাছে ‘বিজাতি থেকে যায় তা নিয়ে সার্থক শিল্প-সৃষ্টি তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। বিদেশী জীবন বা সাহিত্য থেকে আহরিত ভাব চেতনা এমন কি আঙ্গিক চেতনাও আমাদের অনেকের কাছে বিজাতি’-ই থেকে যায়। এমন ভাব-চেতনা নিয়ে কিছুটা আকাশকুসুম হয়তো রচিত হতে পারে কিন্তু সাহিত্যের পুষ্পোদ্যান রচিত হয় না। যে পরিবেশ চেতনায় লেখকের শিল্পীসত্তার বিকাশ ঘটে সেটাকে অতিক্রম করে যে শিল্পকর্ম তাতে কৃত্রিমতার অনুপ্রবেশ অনিবার্য। শিল্পের পক্ষে কৃত্রিমতা সবচেয়ে মারাত্মক।
নানা অভিঘাতে মানুষ অহরহই পরিবর্তিত হচ্ছে–কিন্তু এ পরিবর্তন অত সহজে ঘটে না। সাহেবি পোশাক পরে বাইরে সাহেব হওয়া অতি সোজা ব্যাপার কিন্তু মনের দিক দিয়েও সাহেব হওয়া অত সহজ নয়, এমন কি অসম্ভবও বলা যায়। অথচ মনই সৃষ্টি করে সব রকম সাহিত্য আর শিল্প কর্ম। গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিদ্রোহের একটা লক্ষণ হতে পারে, এ লক্ষণ আমাদের অনেকের রচনায় আছে কিন্তু মনে-প্রাণে পুরোপুরি বিদ্রোহী না হলে সাহিত্যে সত্যিকার বিদ্রোহ আমদানি সম্ভব নয় কিছুতেই। রাজনৈতিক আর সামাজিক বিদ্রোহের চেয়ে সাহিত্যের বিদ্রোহ স্বতন্ত্র। এর উৎস মূল শিল্পীর আভ্যন্তরীণ সত্তায়–আর এর অভিব্যক্তি নবতর ভাব-চেতনায় আর তার রূপায়ণে।
দুই
সব সাহিত্য-শিল্পই সভ্যতার উপকরণ–লেখক আর শিল্পীরা সভ্যতা নির্মাতা আর সভ্যতার কারিগর। মহৎ সাহিত্য-কর্মের ওপরই রচিত হয় সব রকম সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত। মহৎ সাহিত্য মানে মানবাত্মার উদ্ঘাটন ও অভিব্যক্তি। ব্যক্তি আর সমষ্টিগত সব মানুষের জীবনেই বাইরের সঙ্গে ভেতরের দ্বন্দ্ব এক চিরকেলে ব্যাপার। বাহ্যিক জীবনের দাবি আর আভ্যন্তরীণ জীবনের চাহিদা বা আকুতির সংঘর্ষ যেমন অনিবার্য তেমনি তার সমাধান সন্ধানও মানুষের অবিরাম সাধনা। অতীত বা বর্তমান সব মহৎ সাহিত্যে এ সাধনাই প্রতিফলিত। এর সমাধানের পথে বিদ্রোহেরও আবির্ভাব। এ বিদ্রোহ যখন গভীর জীবন-জিজ্ঞাসায় রূপান্তরিত হয় অথবা রচনা আর শিল্পকর্মে যখন তারই সার্থক প্রতিফলন ঘটে তখনই তাকে বিদ্রোহী’ আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। এই বিদ্রোহ মানবাত্মারই অনুষঙ্গ, সভ্যতারই অঙ্গ। এ ছাড়া সভ্যতা এগুতে পারে না, পারে না হতে নবায়িত। স্থির, স্থাণু আর একটা অচলায়তনে বাঁধা পড়া কখনো সভ্যতার আদর্শ নয়। সভ্যতাকে সচল ও সজীব রাখার জন্যেই বিদ্রোহ অত্যাবশ্যক–সভ্যতার প্রধান বাহন। সাহিত্য বলে তাতেই রূপায়িত হয় এ বিদ্রোহ সর্বাগ্রে। এ কারণেই উন্নত সাহিত্যে–বলা বাহুল্য, উন্নত সাহিত্য মানে উন্নত সমাজও–বারে বারে বিদ্রোহ দেখা দেয়–যার ফলে তা হয়ে ওঠে প্রাণ-চঞ্চল ও চলিষ্ণু। তখনই দেখা দেয় সাহিত্যে নবতর ফসল–যা স্বাদে, ভঙ্গিতে আর বৈচিত্র্যে পূর্ববর্তীদের থেকে আলাদা।