রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল, নজরুল থেকে জসীমউদ্দীন, জসীমউদ্দীন থেকে ফররুখ আহমদ আর বুদ্ধদেব থেকে সুধীন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ থেকে সমর সেন, সমর সেন থেকে বিষ্ণু দে স্বতন্ত্র কবি, তাই বলে এরা কেউ কারো বিরোধী নন। অচিন্ত্য-বুদ্ধদেবেরা রবীন্দ্র-বিরোধিতাকেও আধুনিকতার অন্যতম লক্ষণ বলে জোর প্রচার করেছেন। তাই এ কথাগুলি বলতে হলো। না হয়, আমি আগেই বলেছি anti বা বিরোধিতা কোন সৎ লেখকেরই সৎগুণ হতে পারে না। কারণ তা সহজেই শিল্পীর মনে পরিমিতিবোধ নষ্ট করে ভালো রচনার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন জাত-শিল্পী, তাই কোনো কিছুর anti হয়ে তিনি কখনো পরিমিতিবোধ হারান নি। মন-মেজাজে তিনি ছিলেন দগ্ধ ও প্রকৃতি-প্রেমিক–যা ছিল তার শিল্পী সত্তার উৎস–তিনি ছিলেন অবচেতন মনের অনুভব ও অনুভূতির কবি। এর বাইরে রাষ্ট্র বা সমাজ, ধর্ম বা দেবতা নিয়ে তিনি মোটেও মাথা ঘামান নি। কাজেই যে আধুনিকতা এ প্রবন্ধের উপজীব্য তার আওতায় তিনি পড়েন না বলেই তার উল্লেখ আমি অনাবশ্যক মনে করছি। না হয়, এটা জানা কথা–আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তিনি সর্বতোভাবে বিশিষ্ট ওঁ স্বতন্ত্র কবি। মন-মেজাজ, দৃষ্টিভঙ্গি ও সুরে তিনি এতই স্বতন্ত্র যে তার সমসাময়িকদের মধ্যে তাঁর কোনো দোসর নেই। সব কবির মতো গঠন কৌশলে তিনিও যে সাগরেদি করেন নি তা নয়, কিন্তু তার নিজস্ব শিল্পীসত্তা খুঁজে পাওয়ার পর থেকে তিনি নিজেই নিজের তুলনা। তাঁর অনুকারকেরা কেউ এখনো তার বিশিষ্টতা অর্জন করতে পারেন নি।
যাক, এ প্রবন্ধে আমি সাহিত্যে আধুনিকতা সম্বন্ধে যে আলোচনা করলাম তাও আংশিক আলোচনা, হয়তো এক তরফাও। বলা বাহুল্য, আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকেই আলোচনা করেছি, আরো দৃষ্টিকোণ থেকেও এ বিষয়ে ব্যাপকতর আলোচনা হওয়া উচিত। তাহলেই সাহিত্যে আধুনিকতার রূপ ও চেহারা আর তার স্বরূপ স্পষ্টতর হবে এবং নিঃসন্দেহে তা লেখক ও পাঠককে কাছাকাছি আসতে সাহায্য করবে। এখন আধুনিক লেখকদের সঙ্গে আধুনিক পাঠকের অর্থাৎ অধিকাংশ পাঠকের মনের দূরত্ব যে প্রায় সুমেরু-কুমেরু তা বোধ করি সবাই স্বীকার করবেন।
আধুনিক মানুষের উত্তরাধিকার সম্বন্ধে Wilde-এর বিখ্যাত বক্র উক্তি : ‘It is enough that our fathers have believed. They have exhausted the faithfaculty of the species. Their legacy to us is the scepticism of which they were afraid’ পূর্ব পুরুষদের মতো আজ আর আমরা কোনো বিষয়ে সন্দেহ করতে ভয় পাই না। এ সার্বিক সন্দেহ প্রবণতা আধুনিকতার এক বড় লক্ষণ। আরব মনীষী ইবনে রুশদ বলেছেন: ‘সন্দেহ হচ্ছে সব রকম জ্ঞানের উৎস।’ জ্ঞানের উৎস-দ্বার যদি আমাদের সামনে খুলে যায় আর আন্তরিকতা-নাস্তিকতার জুজুর ভয়ে ভীত না হয়ে আমরা যদি সব কিছুকে সার্থক ভাবে সাহিত্যের উপজীব্য করতে পারি, তাহলে আমার বিশ্বাস, সাহিত্যে আধুনিকতা চর্চা আমাদের ব্যর্থ হবে না। এ প্রসঙ্গে ফ্রয়েডের এ মূল্যবান উক্তিটিও স্মরণীয় : ‘Men are strong only so long as they represent a strong idea.’ ত্রিশের সাহিত্যান্দোলনেরও যেটুকু সফলতা তাও এ কারণেই অর্থাৎ তার পেছনে একটা প্রবল ভাব বা স্বপ্ন সক্রিয় ছিল বলেই। সাহিত্যে আধুনিকতারও ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তেমন। কোনো প্রবল ভাব ও ভাবাদর্শের ওপর। শুধু সাহিত্য কেন সব রকম শিল্পান্দোলনেরই গোড়ার কথা এটি। ত্রিশের যুগের লেখকদের স্বপ্ন ছিল, তাই তাঁদের রচনায় স্বপ্নভঙ্গের বেদনা প্রতিফলিত হয়েছে। আজ আমাদের কোনো স্বপ্ন নেই, তাই স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনাহত কোন দুর্মর রূপ আমাদের আধুনিক লেখকদের রচনায় অনুপস্থিত। উপসংহারে আমারও এ আত্মজিজ্ঞাসা: আজ আমাদের মনে কোনো strong idea আছে কি? আছে কি কোনো মহৎ ভাবের প্রেরণা?
[‘সাহিত্যে আধুনিকতা’ প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় রাজশাহী থেকে প্রকাশিত পূর্বমেঘ পত্রিকার মাঘ-চৈত্র ১৩৬৮ সংখ্যায়। এটি পরবর্তীকালে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন গ্রন্থে (১৯৬৫) স্থান পায়।]
সাহিত্যে বিদ্রোহ
এক
সাহিত্যে বিদ্রোহ কথাটার দুটো দিক আছে–একটা ভাবগত অন্যটা আঙ্গিক বা প্রকাশগত। দুইই গভীরতর উপলব্ধি আর জীবনকে দেখার বিশেষ এক দৃষ্টিভঙ্গিরই ফল। যা গতানুগতিকের বিপরীত একটা বৈশিষ্ট্য আর স্বাতন্ত্র্য-চেতনায় যা দীপ্যমান। এ দুই মোটেও বিচ্ছিন্ন বা সম্পৰ্করহিত নয় বরং একটা আর একটারই পরিণতি। গতানুগতিক ভাবই গতানুগতিক ভাষায় রূপ পেয়ে থাকে–স্বতন্ত্র ভাব-চেতনা ভাষা আর প্রকাশেও নিয়ে আসে অভিনবত্ব। সাহিত্যের ভাষা আর ব্যবহারিক আটপৌরে ভাষার পার্থক্যটাও লক্ষ করবার মতো–এ পার্থক্যটাও ঘটে ভাবগত তারতম্যের জন্যেই। নিত্যদিনের বস্তুগত প্রয়োজনে যে ভাষা আমরা প্রয়োগ করে থাকি তা দিয়ে কখনো মানস প্রয়োজন পুরোপুরি মিটতে পারে না, বিশেষত মননশীল মানুষের। আমাদের মানস-খোরাক যেমন দৈহিক খোরাক থেকে আলাদা তেমনি তার প্রকাশের মাধ্যম আর আঙ্গিকও পৃথক। সাহিত্যে মৌখিক বুলির দাবি যখন উত্থাপিত হয় তখন আমরা এ মৌলিক কথাটা ভুলে যাই।
বিদ্রোহের মূল উৎস ভাব বা আইডিয়া–সেখানে বিদ্রোহ দানা না বাঁধলে প্রকাশের বিদ্রোহ কখনো খাঁটি হতে পারে না। নকল পালোয়ানিতে যেমন শক্তির পরিচয় মেলে