আমাদের দেশেও আধুনিক সাহিত্যে তথা সাহিত্যে আধুনিকতার আয়ু নেহাত কম হলো না। যাকে ত্রিশের সাহিত্যান্দোলন বলা হয় তার আয়ু প্রায় চল্লিশ বৎসর। এর মধ্যে সাহিত্যে আধুনিকতার বিকাশ কতখানি ঘটেছে আর উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টি কতখানি হয়েছে তা বিচার করে দেখার সময় এসেছে। উল্লেখযোগ্য অর্থে আমি মনে করছি যা পরবর্তী প্রজন্মও পাঠ করবে–পাঠ করার প্রয়োজন ও আবেদন অনুভব করবে।
বলা বাহুল্য, আধুনিকতা বয়স বা কালের ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে না বলেই রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ বয়সেও আধুনিকতায় পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। এ বিষয়ে। আধুনিকদের অন্যতম পুরোধা বুদ্ধদেব বসুর স্বীকারোক্তি ভুল মনে করার কোনো কারণ নেই। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন : ‘আমরা যা কিছু করবার চেষ্টা করছিলাম অথচ ঠিক পারছিলাম না, সে সবই রবীন্দ্রনাথ করেছেন–কী সহজে, কী সম্পূর্ণ করে, কী অনিন্দসুন্দর ভঙ্গিতে। মনে হলো, বইটা যেন আমাদের অর্থাৎ নবীন লেখকদের উদ্দেশ্য করে লেখা, আমাদের শিক্ষা দেবার জন্যে এটি গুরুদেবের তীব্র মধুর ভর্ৎসনা। অবাক হয়ে দেখলুম রবীন্দ্রনাথের ‘আধুনিক মূর্তি’–সে যে আমাদের চেয়েও ঢের আধুনিক।’ আধুনিক ইংরেজ কবিদের কবিতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ যে মন্তব্য করেছেন আমার মনে হয় তা নতুন করে স্মরণ করার যোগ্য। আমার বিশ্বাস আধুনিক কবিতার দুর্বলতা ও অসাফল্যের বীজ তাতেই সুপ্ত রয়েছে। আমাদের আধুনিক সাহিত্যও জীবনের ফসল নয়–তাই অনেকখানি কৃত্রিম ও ফাঁকা। এও এক সাহিত্য থেকে অন্য সাহিত্যের, এক লেখা থেকে অন্য লেখার উৎপত্তি। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, আধুনিক ইংরেজ তথা য়ুরোপীয় কবিরী না জন্মালে পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক কবিরা জন্মাতেন কি না? জন্মালেও এখন তারা যেভাবে ও যে আঙ্গিকে লিখছেন সেভাবে সে আঙ্গিকে লিখতেন কি? যারা হৃদয়ের উৎস থেকে লেখেন না তাদের লেখারও এ পরিণতি হতে বাধ্য। রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতার চেয়েও ঢের আধুনিক ছিলেন, কিন্তু আধুনিকতা নিয়ে তিনি কোনো বড়াই করেন নি। নজরুলও আধুনিকতার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন তবু তাকেও আধুনিকতা নিয়ে কোনো অহঙ্কার করতে দেখি নি। সাহিত্যে আধুনিকতার সপক্ষে তাকে কখনো সাফাই গাইতেও শোনা যায় নি। জসীমউদ্দীন তো কোনো অর্থেই আধুনিক নন–তবুও এঁরা এ যুগে কিছুটা সার্থক সাহিত্য যে সৃষ্টি করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এঁদের সম্বন্ধে এ কথা কিছুতেই বলা যায় না যে, মধুসূদন কি ইংরেজ কবিরা না জন্মালে রবীন্দ্রনাথ জন্মাতেন না, রবীন্দ্রনাথ না জন্মালে নজরুল ইসলাম জন্মাতেন না। বলা বাহুল্য, এঁরা শুধু বইপড়া কবি নন। এঁদের কবিতার উৎস এদের হৃদয়। রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ের সঙ্গে মস্তিষ্কের মণিকাঞ্চন সংযোগ ঘটেছিল বলে। তার রচনা পেয়েছে সর্বাধিক সার্থকতা, হয়েছে সার্বজনীন। হৃদয়ের সঙ্গে মস্তিষ্কের সংযোগ না ঘটায় নজরুল ও জসীমের লেখায় কী রকম অবিশ্বাস্য সব ক্রটি ঘটেছে তাও কারো চোখ এড়াবার কথা নয়। তবু হৃদয় ও আবেগের স্পর্শে এঁদের অনেক লেখাই যে সার্থক সাহিত্য হয়েছে তা অস্বীকার করা যায় না। নজরুল ও জসীম উভয়েই হৃদয়ধর্মী লেখক, আবেগ এদের বড় সম্বল। বলা বাহুল্য, সাহিত্যে আবেগের মূল্য অনস্বীকার্য। বিশেষত বাংলাদেশে আবেগের মূল্য কখনো অস্বীকৃত ও উপেক্ষিত হবে না। জাত হিসেবে আমরা আবেগ প্রধান। তাই নজরুল আমাদের সবচেয়ে প্রিয় কবি আর শরৎচন্দ্র সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক। গোরার চেয়েও দেবদাসের পাঠক-সংখ্যা অনেক বেশি। এটি একই সঙ্গে আমাদের সবলতা ও দুর্বলতার লক্ষণ।
জসীমউদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠ বা ‘কবর’কে ভাব-ভাষা-ছন্দ ও আঙ্গিকের দিক থেকে কিছুতেই ‘আধুনিক’ বলা যায় না, ব্যক্তি জসীমউদ্দীনও মন-মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে ‘আধুনিক’ নন। অথচ তার এ দুটি কাব্য রচিত হয়েছে সাহিত্যে আধুনিকতার জয় জয়কারের যুগে। আর ‘কবর’ ছাপা হয়েছে কল্লোলেই সর্বাগ্রে। রচনা হিসেবে কাব্য দুটি যে ত্রুটিহীন নয় তাও ঠিক কথা; তবুও কবি-হৃদয়ের আবেগে আর সে আবেগ কবিতায় সঞ্চারিত করে দেওয়ার কৃতিত্বে তা যে সফল হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। অথচ এসব কবিতার ভাষা ও আঙ্গিকে আধুনিকতার কোন লক্ষণ নেই, নেই কোনো চমক–ছন্দও অতি মামুলি। তবুও কবিতা দুটির আকর্ষণ এখনো নিঃশেষ হয়ে যায় নি। মনে হয় না এ কবিতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও মিথ্যে হয়ে যাবে। বিজ্ঞান ও বুদ্ধির চর্চা যতই বাড়ুক না কেন, মানুষ যে কখনো আবেগ বর্জিত হবে তা ভাবা যায় না। আজো আধুনিক কবিতার পাঠক আধুনিক কবিই–এটা কিছুতেই শুভ লক্ষণ নয়।
আমাদের সাহিত্যে আধুনিকতার যুগে একমাত্র সফল হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশ। এ আলোচনায় তার সম্বন্ধে নীরবতার দুটি কারণ–এক, তার সম্বন্ধে আমি অন্যত্র দীর্ঘ আলোচনা করেছি। দ্বিতীয়ত, যে আধুনিকতা নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করলাম, সে রকম অর্থে জীবনানন্দ ‘আধুনিক’ ছিলেন কি না সন্দেহ। যে পরিবেশ ও আবহাওয়ায় আধুনিকতার উৎপত্তি আর আধুনিকতার যে সব লক্ষণ ও গুণাগুণের সবিস্তার আলোচনা এ প্রবন্ধে করা হয়েছে, তার রচনায় সে সবের নিদর্শন দুর্লভ। কোনো বিষয়েই তিনি বিদ্রোহী ছিলেন না, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক অসাম্য সম্বন্ধে তার কোনো দুশ্চিন্তা ছিল বলে মনে হয় না। ঈশ্বর ও প্রেম, দেবতা ও ধর্মের বিরুদ্ধেও তাঁর লেখনী অশনি হয়ে দেখা দেয় নি আর আধুনিক ইউরোপীয় কবিদের কাছে অন্যান্য আধুনিক কবিদের মতো সাগরেদিও করেন নি তিনি। তিনি বা তার রচনা আধুনিক ইংরেজ কবিদের প্রতিধ্বনি ছিল না। তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে স্বতন্ত্র ছিলেন কিন্তু রবীন্দ্র-বিরোধী ছিলেন না। তাঁর রচনার একটি বিশিষ্ট গুণ প্রকৃতি-প্রেম–এ বিষয়ে অন্য আধুনিক কবিদের চেয়েও বরং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মিল বেশি। মোটকথা জীবনানন্দ এক স্বতন্ত্র কবি, বিশিষ্ট কবি–রবীন্দ্রনাথ থেকে তিনি যেমন স্বতন্ত্র তেমনি অচিন্ত্য, প্রেমেন্দ্র, বুদ্ধদেব থেকেও স্বতন্ত্র। স্বতন্ত্র হলেই বিরোধী হয় না। য়েটস আর শ’ একই সময়ের ও একই দেশের লেখক হয়েও স্বতন্ত্র ছিলেন, তাই বলে পরস্পরের বিরোধী ছিলেন না।