এই অনুষঙ্গে এ প্রশ্নটিও প্রায় শোনা যায়, আধুনিক কবিতা দীর্ঘস্থায়ী হবে কি?
আধুনিক মনের সঙ্গে আধুনিক জীবন ও সমাজের বাস্তব অবস্থার সংঘর্ষের ফলেই সাহিত্যে আধুনিকতার আবির্ভাব ঘটেছে। এ কথা আমরা আগেই বলেছি, এ প্রশ্নের উত্তর শুধু এ সংঘর্ষের ওপর নির্ভর করছে না। নির্ভর করছে বিভিন্ন শিল্প-রূপের ভেতর দিয়ে একে শিল্পোত্তীর্ণ করার সামর্থের ওপর। আসল কথা, যদি স্থায়ী হয় তা হলে সাহিত্য কর্মই স্থায়ী তথা দীর্ঘকালীন হবে। শুধু বিষয়গত যে আধুনিকতা তা কখনো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। কারণ, বিষয়ের পরিবর্তন অপরিহার্য ও অনিবার্য। আজ যা বা যে কেথা আনকোরা টাটকা আধুনিক, কাল তা অতীতের বস্তু। আমরা সাহিত্যে দ্বারস্থ হই মন ও কল্পনার খোরাকের জন্য, শুধু বিষয়-নির্ভর সাহিত্য সে খোরাক কিছুতেই জোগান দিতে পারে না। আধুনিক সাহিত্য এত বেশি বিষয়গত ও এত বেশি চটক নির্ভর যে তাতে সাহিত্য পাঠ ও সাহিত্য উপভোগের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। নিছক বিষয়-নির্ভর সাহিত্য যদি মানুষকে খুশি করতে পারতো তাহলে মানুষের কাছে কাব্যের চেয়ে অঙ্কের, উপন্যাসের চেয়ে ভূগোলের কদর হতো বেশি। সাহিত্য যেমন সংবাদপত্র নয় তেমনি সাহিত্যিকেরাও নন রিপোর্টার। রিপোর্টারের সাফল্য বিষয়-নির্ভরতায়, আর সাহিত্যিকের সাফল্য বিষয়কে ছাড়িয়ে যাওয়ায়।
কাজেই আজ অনেকের মনে সন্দেহ জেগেছে সাহিত্যে আধুনিকতা স্থায়ী তথা দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না?
আজকের দিনে বেপরোয়া ও ব্যাপক আধুনিকতা যে সম্ভব নয় সে ইঙ্গিত আগেই করা হয়েছে। যে পরিবেশ ও পটভূমিতে আধুনিকতার জন্ম ও বিকাশ তা যে আজ নির্মূল হয়েছে তা নয়, কিন্তু অনেক দেশের শাসকরা তা সহ্য করবেন না বলেই সে সব দেশে তা ধীরে ধীরে নিষ্প্রাণ ও নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে। হতে বাধ্য হচ্ছে। তাই আজ সমস্ত আধুনিকতা বা ‘প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা’র বিরুদ্ধতার একমাত্র লক্ষ্য হয়েছে কালোবাজার, মুনাফাখখারি, দুর্নীতি, কন্ট্রাক্টার বা জমিদারিহীন জমিদার। এ হচ্ছে এক প্রকার দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। সত্যিকার আধুনিকতার পরিধি ও পরিসর আরো ব্যাপক ও গভীর। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাকে যদি বদলাতে হয় এবং তা যদি আধুনিকতার অন্যতম লক্ষ্য হয়, তা হলে মূলেই আঘাত করতে হবে–শুধু পত্রপল্লবে খোঁচা দিয়ে সে উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। আশ্চর্য, যেসব দেশ রাষ্ট্র মনেপ্রাণে কমিউনিজম বিরোধী তারা কমিউনিজম তথা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের যা দোষ তা নিজেরা গ্রহণ করে হাতের অস্ত্রে পরিণত হয়েছেন আর তা নির্বিবাদে প্রয়োগ করেছেন যারা কমিউনিজমের গুণ গ্রহণে উৎসাহী তাদের ওপর। কমিউনিজমে যদি কোন গুণ থাকে তাও উল্লেখ করার কোনো অধিকার স্বাধীন বিশ্বের শিল্পীদের নেই। স্বাধীন বিশ্বের শিল্পীদের সামনে এও আর এক অনতিক্রম্য সীমান্ত! আধুনিকতা মানে জীবনের সব দিক, সব কিছুকে গ্রহণ করা, সব কিছুকে অকপটে যাচাই বাছাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। মানুষের সমাজ-ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কমিউনিজম এক নবতর মতবাদ। এ মতবাদের ভালো-মন্দ, সু-কু যাচাই-বাছাইয়ের অধিকার থেকে ‘স্বাধীন বিশ্বে’র শিল্পীরা বঞ্চিত। ভুল বললাম–মন্দ আর কু বলার অর্থাৎ অ্যান্টি হওয়ার অধিকার আছে বই কি! ‘স্বাধীন বিশ্বে’র অধিকাংশ রাষ্ট্র চায় আপনি anti হউন–রাষ্ট্রের এ দাবি না মানলে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র থেকে যে সব অস্ত্র ধার করা হয়েছে তার হাত থেকে আপনারও রেহাই নেই। কিন্তু খাঁটি শিল্পী তো anti হতে পারে না–anti ব্যাপারটিই শিল্পীর জন্য মারাত্মক। এ প্রসঙ্গে জোলা রচিত শিল্পী-সাহিত্যিকদের ম্যানিফেস্টো স্মরণীয়। শিল্পীর প্রধান ভূমিকা তো ভাবাত্মক, নঞর্থক নয়। অ্যান্টি অকমিউনিস্ট হতে গেলে মানুষের কী দুর্দশা ঘটে তার এক সার্থক চিত্র এঁকেছেন বোরিস পাস্তেরনাক কিন্তু কাট্টা অ্যান্টি কমিউনিস্ট হলে কী দুর্দশা ঘটে তার চিত্র আঁকা হতে এখনও বাকি। স্বাধীন বিশ্বের আধুনিক লেখকদের কেউ কি বিপরীত অর্থে পাস্তেরনাক হতে পারেন না? স্বাধীন বিশ্ব’ কথাটা হেঁয়ালি। কারণ একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারা যাবে ‘অ্যান্টি আর ‘স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী কথা। স্বাধীন ইচ্ছার বিরুদ্ধে শিল্পীকে অ্যান্টি হতে হবে, ‘প্রো’ না হোক, নিরপেক্ষও তিনি থাকতে পারবেন না–এ এক চরম জবরদস্তি নয় কি? এ জবরদস্তির চিত্রই তো ডক্টর জিভাগো। স্বাধীন বিশ্বের বহু রাষ্ট্রে এর বিপরীত যে জবরদস্তি চলেছে তার চিত্রও এক মহৎ উপন্যাসের বিষয়বস্তু হতে পারে।
ছয়
এ শতাব্দির গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডের কাব্য-সাহিত্যে মন্দা দেখা দিয়েছিল অর্থাৎ কবিতা অনেকখানি কৃত্রিম ও ফাঁকা হয়ে পড়েছিল। তখন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিলাতে। তিনি সহজাত কবি ও তীক্ষ্ণ মনীষার অধিকারী–এ কৃত্রিমতার কারণ ও স্বরূপ তার স্ফটিক-স্বচ্ছ মনে ধরা পড়তে দেরি লাগে নি। এ প্রসঙ্গে তিনি যে মন্তব্য করেছেন তা স্মরণীয় এবং মনে হয়, তা আমাদের আধুনিক কাব্য সম্বন্ধেও সর্বতোভাবে প্রয়োগ করা যায়:
“ইংল্যান্ডের বর্তমান কালের কবিদের কাব্য যখন পড়িয়া দেখি তখন ইঁহাদের অনেককেই আমার মনে হয়, ইহারা বিশ্বজগতের কবি নহেন, ইহারা সাহিত্য জগতের কবি। এ দেশে অনেকদিন হইতে কাব্য সাহিত্যের সৃষ্টি চলিতেছে–হইতে হইতে কাব্যের ভাষা উপমা অলঙ্কার ভঙ্গি বিস্তর জমিয়া উঠিয়াছে। শেষকালে এমন হইয়া উঠিয়াছে যে কবিত্বের বা কাব্যের মূল প্রস্রবণে মানুষের না গেলেও চলে, কবিরা যেন ওস্তাদ হইয়া উঠিয়াছে, অর্থাৎ প্রাণ হইতে গান করিবার প্রয়োজনবোধই তাহাদের, চলিয়া গিয়াছে; এখন কেবল গান হইতে গানের উৎপত্তি চলিতেছে। যখন ব্যথা হইতে কথা আসে না, কথা হইতেই কথা আসে, তখন কথার কারুকার্য ক্রমশ জটিল ও নিপুণতর হইয়া উঠিতে থাকে; আবেগ তখন প্রত্যক্ষ ও গভীরভাবে হৃদয়ের সামগ্রী না হওয়াতে সে সরল হয় না; সে আপনাকে আপনি বিশ্বাস করে না বলিয়াই বলপূর্বক অতিশয়ের দিকে ছুটিতে থাকে; নবীনতা তাহার পক্ষে সহজ নহে বলিয়াই আপনার অপূর্ব প্রমাণের জন্য কেবলি তাহাতে অদ্ভুতের সন্ধানে ফিরিতে হয়। এখনকার কাব্য সাহিত্যের যুগে কবি য়েটস যে বিশেষ সমাদর লাভ করিয়াছেন, তাহার গোড়ার কথাটা ঐ। তাঁহার কবিতা তাঁহার সমসাময়িক কাব্যের প্রতিধ্বনির পন্থায় না গিয়া নিজের হৃদয়কে প্রকাশ করিয়াছেন। …কবি য়েটসের কাব্যে আয়লন্ডের হৃদয় ব্যক্ত হইয়াছে।”