ফলে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক লেখকদের প্রথম রচনাই তাদের * শ্রেষ্ঠ রচনা এবং সেটি একমাত্র উপভোগ্য। পরেরগুলির কোনো কোনোটায় হয়ত পরিণতির পরিচয় পাওয়া যায় কিন্তু প্রথমটির স্বকীয়তা, নগ্নতা ও কাঁচার যে স্বাদ তা আর ওইসবে যায় না পাওয়া। এ প্রসঙ্গে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা আন্দোলনের নেতা প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রথমা, অচিন্ত্য সেনগুপ্তের অমাবস্যা ও বুদ্ধদেব বসুর বন্দীর বন্দনা স্মরণীয়। ফররুখ আহমদের সাত সাগরের মাঝি সম্বন্ধেও কি একথা বলা যায় না? কিন্তু আশ্চর্য, রবীন্দ্রনাথ আধুনিক না হয়েও শেষ পর্যন্ত কিন্তু আধুনিক থেকে গেছেন। আমৃত্যু তিনি ছিলেন যা চলতি তার পরিপন্থী, প্রচলিত সামাজিক ধ্যান-ধারণার বিরোধী।
কালান্তর, চতুরঙ্গ ইত্যাদি তার প্রায় বৃদ্ধ বয়সের রচনা, তা হলেও তাতে ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রচলিত মতামত কিছুই রেহাই পায় নি। চতুরঙ্গের জ্যাঠা মশায় বা জগমোহনের মত অমন পাক্কা নাস্তিকের চরিত্র আমাদের কোনো আধুনিক লেখকই এ পর্যন্ত আঁকতে পারেন নি। তাই মনে হয়, আধুনিকতা বয়সের ওপর নির্ভর করে না–ওটা মনের ধর্ম, মনের ব্যাপার। আমি মনে করি, জীবনের সবগুলো দিককে স্বীকার করে নেওয়ার নামই যথার্থ আধুনিকতা। তবে স্বীকৃতি আর প্রকাশের মাঝখানে যে ‘আসমান-জমিন ব্যবধান রয়েছে তার উপলব্ধির ওপর নির্ভর করে সাহিত্যে আধুনিকতার সফলতা। যুদ্ধোত্তর যুগে আধুনিকতার যে স্পর্ধিত রূপ আমরা দেখতে পেয়েছি তার বহু আগে থেকেই ফরাসি সাহিত্যিকেরা জীবনের সব কিছুকেই, সব দিককেই সাহিত্যের উপজীব্য করেছেন। জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো কিছুকেই তারা সাহিত্যে বর্জনীয় বা পরিত্যাজ্য মনে করেন নি। জীবনের বিচিত্র রূপ ফরাসি শিল্পীরা অকপটে এঁকেছেন–এ ব্যাপারে তারা কোনো দ্বিধা সংকোচ বোধ করেন নি। ফলে ফরাসি সাহিত্য একদিন জুগিয়েছিল ইউরোপের তাবত জ্ঞানী, গুণী ও রসিকের মনের খোরাক। লেখক ও শিল্পীদের হয়ে জোলা (১৮৪০-১৯০২) যে ঘোষণাপত্র’ বা Manifesto রচনা করেছিলেন তাতে নিঃসন্দেহে ফরাসি সাহিত্যিক-শিল্পীদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে : First, we think all truth beautiful, no matter how hideous its face may seem. We accept all of nature, without any repudiation. We believe there is more beauty in a harsh truth than in a pretty lie, more poetry in earthness than in all the salons of Paris. We think pain good, because it is the most profound of all human feelings. We think sex beautiful, even when portrayed by a harlot and a pimp. We put character above ugliness, pain above prettiness and hard, crude reality above all the wealth in France. We accept life in its entirety, without making moral judgements. We think the prostitute as good as the Countess, the concierge as good as the general, the peasant as good as the cabinet minister. for they all fit into the pattern of nature and are Woven into the design of life,’ বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রমথ চৌধুরী ওরফে বীরবল ফরাসি সাহিত্য সম্বন্ধে পণ্ডিত ও ওয়াকিবহাল ছিলেন। এ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য হচ্ছে : ‘একথা সত্য যে, সত্যের অনুসন্ধানে মনোরাজ্যের হেন দেশ নেই যেখানে ফরাসি লেখকরা যেতে রাজি নন, সে দেশ যতই অপ্রীতিকর ও যতই অসুন্দর হোক এবং সত্যের খাতিরে হেন কথা নেই যা তারা বলতে প্রস্তুত নন, সে কথা যতই অপ্রিয় যতই অবক্তব্য হোক।’
কাজেই সাহিত্য ব্যাপারে আধুনিকতা বড় কথা নয়–অকপটে জীবন তথা জীবনের সত্যকে উদ্ঘাটনই বড় কথা। তবে শিল্পের স্বভাব ও ধর্ম হচ্ছে অর্জন ও বর্জন, ত্যাগ ও গ্রহণ, যাচাই ও বাছাই–শিল্পে তিলোত্তমা গড়ে ওঠে এভাবে।
অনেকের সাহিত্যে আধুনিকতা সম্বন্ধে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই কিন্তু আধুনিক হওয়ার ঝোঁক আছে। বিশেষত, যারা তথাকথিত সমাজ-সচেতন শিল্পী তাদের ঝোঁকটাই প্রবলতর। এটা নিন্দার কথা নয়, বরং স্বাস্থ্যের লক্ষণ, সজাগ মনের পরিচায়ক। তবে আধুনিকতারও সীমা আছে, আর আধুনিকতা লক্ষ্য নয়, উপায় মাত্র–এ দুটো কথা স্মরণ রাখার ওপর আমি জোর দিতে চাচ্ছি।
পাঁচ
আধুনিক কবিতা সম্বন্ধে এক সুপরিচিত আপত্তি হচ্ছে আধুনিক কবিতা দুর্বোধ্য। এ আপত্তি সম্বন্ধে আমি অন্যত্র অন্য প্রবন্ধে আলোচনা করেছি। জীবনের জটিলতা, প্রতাঁকের ব্যাপক ব্যবহার, স্বল্প কথায় বেশি অর্থারোপ যে এ জটিলতার এক বড় কারণ তাতে সন্দেহ নেই। তবুও পাঠকের পক্ষ থেকে প্রশ্ন উঠতে পারে, কোনো মহৎ কবি কি দুর্বোধ্য? বা অবাধ্য? বিখ্যাত সমালোচক Ivan Brown বলেছেন ‘No great poet at his best is obscure, The artist who does not know his own intentions is a pretender. If he does know them and can not express them he is merely incompetent.
কাজেই কবি বা লেখকের প্রথম ও প্রধান শর্ত নিজের মন জানা, তারপর তাকে প্রকাশ করা। তা হলে আমার বিশ্বাস প্রতীক-ধর্মী লেখাও অবোধ্য মনে হবে না।