‘… বেদে থেকে পরম পুরুষের রহস্য বোঝা যায় একমাত্র এইভাবে যে সাহসিকতায় চিন্ময় সৃজনের দুর্মর অভিলায় সমগ্র কল্লোলী লেখকদের প্রয়াস নিঃশেষিত।’
(বাংলা উপন্যাসের কালান্তর, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়। পৃ২৮২)
বুদ্ধদেবের যা কিছু সাফল্য সে তো গদ্য রচনায়। নিঃসন্দেহে আধুনিক কবিতার সার্থক ভাষ্যকার তিনি। কিন্তু সফল আধুনিক কবি তিনি নন। বরং এঁদের তুলনায় আধুনিকতা সম্বন্ধে কোনো স্পর্ধা না করে মোহিতলাল কি তারাশঙ্কর লেখক হিসেবে যে সফলতা অর্জন করেছেন তার গুণগত মূল্য অনেক বেশি। এমন কি আমাদের জসীম উদ্দীনের সফলতাও এঁদের অনেকের চেয়ে বেশি ছাড়া কম নয়।
আমার বিশ্বাস, শেষোক্তদের সাফল্যের বড় কারণ এরা নিজেরা যা তা-ই অর্থাৎ এরা নিজেদের স্বকীয়তা ও নিজস্বতা কখনো বিসর্জন দেন নি–এঁরা ‘ধার করা’ কবি বা লেখক নন, হতে চান নিও। এঁদের মন-মানস যতটুকু যা যেভাবে গ্রহণ করতে পেরেছে। এরা ততটুকুই। আমাদের সাহিত্যে কবিতার ক্ষেত্রেই আধুনিকতার তোড়জোড় সব, চেয়ে বেশি। অথচ সেই কবিতার ক্ষেত্রে আধুনিকতা সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ হয়েছে অর্থাৎ কোনো সুপরিণতিতে গিয়ে পৌঁছাতে পারে নি এখনো। এ প্রসঙ্গে এ কথাও বিবেচ্য আধুনিকতার ব্যর্থতার বীজ হয়ত আধুনিকতার মধ্যেই রয়েছে সুপ্ত। মোটামুটিভাবে আমরা দেখতে পেয়েছি আধুনিকতা হচ্ছে একটা দৃষ্টিভঙ্গি, একটা attitude মাত্র—’A hostile attitude to society and all its institutions’ ইউরোপের ও আমাদের দেশের আধুনিক নামে পরিচিত রচনার দিকে তাকালেই Spender-এর এ উক্তির তাৎপর্য বুঝতে পারা যাবে।
সমাজের সঙ্গে কবি বা শিল্পী-মনের যে সংঘর্ষ তা যতদিন রচনায় অব্যাহত রাখা। যায়, রচনায় ধারও থাকে ততদিন এবং ততদিন সে রচনা থাকে উপভোগ্য। কিন্তু তা। নিঃশেষ হয়ে গেলে রচনা তার বৈচিত্র্য ও ধার হারিয়ে নিছক একটা ভঙ্গি হয়েই দাঁড়ায়। বলা বাহুল্য, ভঙ্গি সফলতা নয় বরং দুর্বলতা। Stephen Spender আধুনিক কবিতার 677 786 761654, ‘To create an art at once extremely contemporary and with a dreamlike quality.’ এ প্রসঙ্গে তিনি ভ্যান্ গগের ছবির কথা তুলনা করেছেন। ভ্যান গগ তার আশে-পাশের জীবন ও প্রকৃতি থেকেই তার ছবির উপকরণ নিয়েছেন এবং তাতে মাখিয়ে দিয়েছেন স্বপ্নের অঞ্জন। তাই তা আধুনিক হয়েও ছাড়িয়ে গেছে আধুনিকতার সীমা, হয়েছে চিরন্তন শিল্প। এর জন্যে কোন দুঃখকেই তিনি দুঃখ মনে করেন নি। কিন্তু অমন দুর্জয় মনোবল আর নিজেকে নিজের মনের মতো করে প্রকাশ করার অমন দুর্বার ইচ্ছাই বা ক জনের থাকে, ক জনের আছে?
সাফল্যই তো আমাদের এক পরম শত্রু–সাফল্যের সূচনাতেই আমরা ভেঙে পড়ি, হয়ে পড়ি আদর্শচ্যুত; তখন নিজের দৃষ্টিভঙ্গি আর আদর্শের হতে থাকে বদল। জীবিকার দরাজ নিরাপত্তা মন থেকে দূর করে দেয় সব বিক্ষোভ ও বিরুদ্ধতা। এতদিন যা ছিল অসহনীয় এখন তা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে সহনীয়।
আধুনিকতারও শত্রু এ সাফল্য–জীবনে সফলতা এলে আধুনিক জীবনের রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে সংগ্রামের প্রয়োজন আর থাকে না। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তখন আর থাকে না ক্ষোভ। চলতি সমাজে যা কিছু মূল্যবান তাকে মূল্যহীন মনে করার ওপরই নির্ভর করে আধুনিকতা। কিন্তু সে সব যখন শিল্পীর নিজেরই করায়ত্ত হয় তখন তা হয়ে ওঠে মূল্যবান।
ফলে সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ঘটে ভরাডুবি। সিএসপি হওয়ার পর আধুনিকতা করার কোনো মানে হয় কি? তেমনি গাড়ি বাড়ি ও সফল বিয়ের পর শিল্পীর মন থেকে আধুনিকতার সব প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, যেতে দেখা গেছে।
জীবনে সফলতার সঙ্গে সঙ্গে রচনাতেও অধিকতর আধুনিকতার সুর ফুটেছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। কাজেই যে কবিতা বা সাহিত্য সফলতার দিনেও সফল নয় তার শেষ পরিণতি আঙ্গিকে ভঙ্গি আর ভাবে পুনরাবৃত্তি। এভাবে আজকের আধুনিকও একদিন চলতি ঐতিহ্য ও সমাজে ফিরে যান, ফিরে যেতে বাধ্য হন। মনের ত্রিসীমানাতেও তখন আর স্থান পায় না বোহেমিয়ানিজম বা বাউণ্ডুলেপনা। বরং এখন থেকে শিল্পী বেশ কষে চর্চা করতে থাকেন নকল বনেদিয়ানা। এর ফলেই একদিন যারা বাংলা সাহিত্যে আধুনিক বলে পরিচিত ছিলেন তারা আজ আর তা নন। স্বভাবতই সামাজিক মর্যাদাই নিয়ে আসে। সমাজের সঙ্গে আপোষের ইচ্ছা। আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা ছাড়া আরো অনেক কারণে আধুনিকতার পতন ঘটতে পারে।
আজ অনেক দেশের রাজনৈতিক অবস্থা এমন যে সেখানে খাঁটি স্বেচ্ছাচারী তথা আধুনিক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে সে সব দেশে আধুনিকতা কেতাবি বা academic হয়ে পড়তে বাধ্য।
তার ওপর সারাজীবন সমাজের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চরিত্র-শক্তি কয়জুনের থাকে? ফলে আপোস না করে উপায় থাকে না। যখন বয়স, সংসার ও পরিবারের বোঝা একটির পর একটি বাড়তে থাকে তখন তার সঙ্গে একটা আপোস করে চলার গতি আরো তরান্বিত হয়। তখন public বা সাধারণ পাঠক যা চায়, যা দিলে সরকারি বেসরকারি অনুগ্রহের পথ হয় সুগম, শিল্পী তা-ই করতে থাকেন, দিতে থাকেন চাহিদা মতো মাল। যে বিদ্রোহ, নৈরাশ্য, হতাশা, বিক্ষোভ নিয়ে লেখকের লেখক জীবনের শুরু এভাবে তার আগুন দিনে দিনে স্বাভাবিক নিয়মেই ঠাণ্ডা হয়ে আসে। এসব বহুতর। কারণে আধুনিকতা স্বল্পায়ু হতে বাধ্য।