নানা দেশের নানা কালের মানবতাবাদীরা যে মহাসড়ক ধরে এগিয়ে গেছেন সেই সড়কেরই একজন অভিযাত্রী আবুল ফজল। এদের সবার লক্ষ্য অভিন্ন। কিন্তু এদের সবারই রয়েছে। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, চলার নিজস্ব ধরন। অন্যান্যদের মতো আবুল ফজলের মানবতন্ত্র ও তেমনি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। উদার মানবিকতা সম্পর্কে পশ্চিমি ভাব-ধারণার বিকাশ এ দেশে অনেক আগেই ঘটেছিল।
উনিশ শতকের বাংলার রেনেসাঁসের অন্যতম অগ্রপথিক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০ ১৮৯১) উদার মানবিকতা চর্চার যে ধারা সূচনা করেছিলেন সেই ধারার নব উত্তরণ ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথের হাতে। বিশ শতকের শুরুতে রুশ বিপ্লব (১৯১৭)ও রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের বিজয় অভিযানের প্রভাবে এ দেশে সূচিত মুক্তি আন্দোলনের জোয়ারে উদার মানবিকতার চিন্তায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল। বুর্জোয়া মানবতাবাদী চিন্তা থেকে সরে এসে এ ধারার সমাজতান্ত্রিক মানবতাবাদী চিন্তার পথে ধীরে ধীরে উত্তরণ ঘটছিল। কিন্তু সমসাময়িককালে বাঙালি মুসলমান সমাজ ধর্মীয় গোঁড়ামি, অন্ধ প্রথানুসরণ ও আধুনিক শিক্ষা বিমুখতার যে পথ বেছে নিয়েছিল তাতে উদার-মানবিক চিন্তাধারা থেকে একটা উল্লেখ্যযোগ্য দূরত্ব রচিত হয়ে গিয়েছিল। শিখা গোষ্ঠীর মাধ্যমে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ থেকে শুরু করে আমৃত্যু আবুল ফজল মানবতন্ত্রের পক্ষে যে আদর্শিক লড়াই করে গেছেন তা বাঙালি মুসলমানদের উদার মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে।
আবুল ফজল মানবতন্ত্রী। কিন্তু মানুষের সত্যিকারের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম-সংগঠনের বিশেষ পথে তিনি অগ্রসর হন নি। তিনি প্রধানত লেখন ও মননচর্চাকেই এই পথের প্রধান অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এবং মূলত তাকেই অবলম্বন করেছিলেন। তবে রাজনীতির প্রতি তিনি যে চোখ ফিরিয়ে ছিলেন তা মোটেও নয়। বরং বলা যায়, রাজনীতিকেও তিনি ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তা করেছেন ‘মানবতন্ত্রী’ চোখ দিয়ে। সেই কারণেই তিনি যখনই দেখেছেন যে রাজনীতি মানব-মর্যাদার অবমাননা ঘটাচ্ছে তখনই তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।
বিষয়টি স্বচ্ছ হয়ে ওঠে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার নিরিখে আবুল ফজলকে বিচার করলে। পাকিস্তানের জন্মের মধ্যে আবুল ফজলের হয়ত-বা ক্ষীণ প্রত্যাশা জেগেছিল–নতুন দেশটিতে মানব-মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই কারণেই হয়ত তিনি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর (১৮৭৬ ১৯৪৮) মধ্যে একজন মানবতন্ত্রীকে আবিষ্কার করতে গিয়েছিলেন (কায়দে আজম [১৯৪৬] নাটক দ্রষ্টব্য) কিন্তু পাকিস্তানের জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই আবুল ফজল দেশে মানবতার লাঞ্ছনা ও অবমাননা দেখে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় উন্মাদনা ও অন্ধ গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এবং মানব মর্যাদার পক্ষে কলম ধরেছেন। রাঙা প্রভাত (১৯৫৭) উপন্যাসে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তর ও নবতর বিন্যাসের মাধ্যমেই সত্যিকার মানবতন্ত্রে পৌঁছানো সম্ভব।
মানবতন্ত্রী আবুল ফজলের উদার মানবতাবাদী চিন্তাধারার অন্যতম দলিল ‘মানবতন্ত্র’ রচনাটি। তার রাঙাপ্রভাত উপন্যাসের বিরুদ্ধে আনীত তথাকথিত ‘ইসলাম বিরোধী’, ‘পাকিস্তানি ভাবধারার পরিপন্থী’ ইত্যাদি অভিযোগ খণ্ডন করতে গিয়ে আবুল ফজল এই প্রবন্ধটি রচনা করেছিলেন। ১৯৬০-এর দশকে পূর্ব বাংলার শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী। উদারনৈতিক চেতনা বিকাশে এই রচনাটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। যে ধর্মান্ধতা ও কূপমণ্ডুকতাকে বাঙালি মুসলমানদের মানস বিকাশের পথ রুদ্ধ করার কাজে সে সময় ব্যবহারের হীন প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল তার স্বরূপ উদঘাটন করে এবং তার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ উচ্চারণ করে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, ধর্মান্ধতা নয়–মানবতন্ত্রের মধ্যেই মানুষের সত্যিকারের বিকাশ ঘটে। মানবতন্ত্র রচনায় আবুল ফজল মানবতন্ত্র সম্পর্কে তার প্রধান প্রধান উপলদ্ধি নিয়ে সমুপস্থিত; মানুষের মর্যাদার প্রতি সর্বাধিক সম্মান প্রদর্শনের কথা এখানেই উচ্চারিত। মানবতার মর্মবস্তু তথা মানব কল্যাণের বিষয়, মানুষের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ও সমাজ জীবনে মানবিক মূল্যবোধের অনুকূল পরিবেশ রচনার বিষয়ে মহৎ উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ এখানেই ঘটেছে; শোষণের বিরুদ্ধে, অন্ধ বিশ্বাস ও প্রথানুগত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং সমাজ প্রগতির পক্ষে দাঁড়ানোর মতো সত্যকারের মানবতাবাদী চিন্তাধারা এখানেই উদ্ভাসিত, এখানেই তিনি টেনে এনেছেন ব্যক্তির মুক্তির প্রসঙ্গ; এনেছেন ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কথা, এনেছেন মানুষের মুক্তি ও আনন্দ রচনার জন্য জাগতিক আকাক্ষা ও চাহিদা পরিপূরণের বিষয়।
‘মানবতন্ত্র’ প্রবন্ধে আবুল ফজল সবার উপরে মানুষের মর্যাদাকে সমুন্নত করে তুলে ধরেছেন। মানুষের মর্যাদাকে যদি মানুষ যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম না হয় তবে অমানুষিকতা ও বর্বরতারই বিজয় অনিবার্য হয়ে উঠবে। তাই প্রাণিজগৎ থেকে উদাহরণ দিয়ে আবুল ফজল মানুষের মনুষ্যত্ববোধকে জাগরিত করার প্রয়াস পান :
মানুষকে অমানুষিকতার হাত থেকে বাঁচাতে হলে মানবতাকেই করতে হবে এক মাত্র অবলম্বন। কথা আছে : বাঘ বাঘের মাংস খায় না। কথাটা সত্য। বাঘও বাঘের বেলায় নিজেদের সাধারণ ব্যাঘত্ব সম্বন্ধে সচেতন। ব্যাঘ্ৰত্বে পরস্পর অভিন্ন। অতএব অবধ্য। মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে সাধারণ মানবতা সম্বন্ধে।