এ প্রসঙ্গে অচিন্ত্য সেনগুপ্তের বেদে পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে যা লিখেছিলেন তা স্মরণীয়: ‘রচনার যে বিশিষ্টতা বাহ্যিক তোমার পক্ষে তার প্রয়োজন ছিল না। যারা অল্পশক্তি তারাই রচনায় নতুনত্ব ঘটাতে চায়–চোখ ভোলানোর জন্যে। কিন্তু যখন তোমার প্রতিভা আছে তখন তুমি চোখ ভোলাবে কেন, মন ভোলাবে।’
সাহিত্যে জোর করে আধুনিক হওয়ার তথা ‘চোখ ভোলাবার’ চেষ্টায় আজ অনেক শক্তিমান লেখক যে শক্তি ও সময়ের অকারণ অপচয়ে লিপ্ত তার নজির কিছুমাত্র বিরল নয়। চমক লাগানো ব্যাপারটিই তো আসলে স্বল্পায়ু। কিন্তু সাহিত্য-শিল্প তো একদিনের বাদশা’ নয়। শুধু ভাষা আর আঙ্গিকে চমক সৃষ্টি করে যারা একদিনের বাদশা’ হতে চান তাঁদের সম্বন্ধে Irving Stone-এর বক্তব্য হচ্ছে ‘The man of the day is usually man of a day’.
এঁদের অনেকের রচনা দৈনিকের মতই, একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই ব্যাস। যে জিনিস চিরকালের না হোক অন্তত কিছু কালের, তাকে দৈনিকের বস্তু করে তোলার সার্থকতা কোথায়?
আধুনিকতায় যে সব লক্ষণ ও গুণ তা যে একেবারে ব্যর্থ ও মূল্যহীন সে কথা বলা যায় না। নির্জলা সত্যভাষণের ও জীবনের নগ্ন বাস্তবতার রূপায়ণের দুঃসাহস, সর্ববিষয়ে। কৌতূহল, জিজ্ঞাসা, প্রশ্ন ও হতাশা মহৎ সাহিত্যের উপজীবিকা যে হতে পারে না তা। নয়। প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ অনেক সময় নতুনকে গ্রহণ করার পথ সুগম করে দেয়। কল্পনায় ও প্রকাশে দুঃসাহস আধুনিকতার অন্যতম লক্ষণ। তার সঙ্গে গভীর ও আন্তরিক মননশীলতার সংযোগ না ঘটলে শিল্প-সৃষ্টি সার্থক হতে পারে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।
সাহিত্যে যত রকমের ধারা ও যত মোড় বদল ঘটেছে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ছিল, আর সব ধারা-উপধারাই স্থান পেয়েছে তার বিপুল রচনায়। ক্লাসিসিজম, রোমান্টিসিজম, রিয়ালিজম, মডার্নিজম–সব কিছুরই নিদর্শন ছড়িয়ে আছে তার অজস্র লেখায়। ফটোগ্রাফি যেমন শিল্প নয় তেমনি নির্ভেজাল অর্থাৎ যে রিয়ালিজমে কল্পনার রঙ মেশে নি তাও সাহিত্য নয়। অতি আধুনিকদের অনেক রিয়ালিজম চর্চা এ কারণেই সাহিত্য হিসেবে ব্যর্থ হয়েছে। সাহিত্য নিয়ে এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর এ সম্বন্ধে এত দীর্ঘ অভিজ্ঞতাও রবীন্দ্রনাথের মত এ যুগের আর কারো নেই। কাজেই এ সম্পর্কে তাঁর মতামত এক রকম প্রামাণ্য ও অপ্রতিরোধ্য বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। আধুনিক সাহিত্য ও কবিতা সম্বন্ধে তিনি বহুবার মন্তব্য করেছেন। এখানে একটি মাত্র মন্তব্য, উদ্ধৃত হলো :
‘…আমাদের দেশের হাল আমলের কাব্য, যাকে আমরা আধুনিক বলছি যদি দেখি তার দেহরূপটাই অন্য দেহরূপের প্রতিকৃতি, তা হলে তাকে সাহিত্যিক জীবসমাজে নেব কী করে। যে কবিদের কাব্যরূপ অভিব্যক্তির প্রাণিক নিয়ম পথে চলেছে তাদের রচনার স্বভাব আধুনিকও হতে পারে সনাতনীও হতে পারে অথবা উভয়ই হতে পারে। কিন্তু তার চেহারাটা হবে তাদেরই, সে কখনো এলিয়েটের বা অডেনের বা এজরা পাউন্ডের ছাঁচে ঢালাই করা হতে পারে না। … যে কবির কবিত্ব পরের চেহারা ধার করে বেড়ায় সত্যকার আধুনিক হওয়া কি তার কর্ম?’
আধুনিক কবিরা সত্যকার আধুনিক হচ্ছেন না বলেই আমাদের আপত্তি এবং তাঁদের রচনা সম্বন্ধে তাই আমরা নিঃসন্দেহ হতে পারছি না। নিঃসন্দেহ হতে না পারার বড় কারণ, তারা কবির চেয়েও বিশেষণটার ওপর জোর দিচ্ছেন বেশি। তারা। যতখানি ‘আধুনিক’ হতে চাচ্ছেন ততখানি ‘কবি’ হতে চাচ্ছেন না। তারা অহঙ্কার করছেন কবিতা নিয়ে নয়, আধুনিকতা নিয়ে। জোর দেওয়া হচ্ছে কে কতখানি আধুনিক তার ওপর।
মানুষ যেমন বিচ্ছিন্ন নয়, তেমনি তার সাহিত্য বিচ্ছিন্ন নয়। বর্তমানের অতিরিক্ত তার যেমন অতীত ও ভবিষ্যৎ আছে–সাহিত্যেরও তাই আছে। বর্তমানের যোগসূত্রে এ তিন একই মালার ফুলের মতো এক সুতোয় গাঁথা। এ উপলব্ধির ওপরই নির্ভর করছে রচনার সাহিত্যিকতা। সব লেখকই এ অর্থে আধুনিক যে, তাকে রচনার উপকরণ। প্রকরণ সংগ্রহ করতে হয় তার কাল থেকে, তার যুগ থেকে। সব শিল্পীই যুগ-সন্তান। কিন্তু শিল্পী সত্তায় তাঁকে ছাড়িয়ে যেতে হয় যুগকে।
আধুনিক হওয়ার সংকল্প নিয়ে কলম হাতে লিখতে বসলেই আধুনিক হওয়া যায়। না–মনের ভেতর আধুনিকতার বোধ থাকা চাই অর্থাৎ কালের ধারাবাহিকতার বোধ। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের, বর্তমানের সঙ্গে ভবিষ্যতের যে অবিচ্ছিন্ন যোগসূত্র আছে তা কালের দিক থেকে যেমন সত্য তেমনি মানুষের শ্রেয়, সৌন্দর্য ও রসবোধের দিক থেকেও সত্য। তা না হলে প্রাচীন সব সাহিত্যই আজ বাতিল হয়ে যেত। অথচ তা তো হয় নি, বরং বহু আধুনিক লেখাই যথেষ্ট চাকচিক্য সত্ত্বেও ক্ষণ-প্রভার মতো কোথায় বিলীন হয়ে গেছে। তাই সাহিত্যে আধুনিকতা নিয়ে যাদের বড়াই তাঁদের হাত থেকে আমরা কতটুকু ফসল পেয়েছি পাঠকের পক্ষ থেকে এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
চার
ইনজেকশন যেমন হারানো স্বাস্থ্যোদ্ধারের উপায় মাত্র, লক্ষ্য নয়–লক্ষ্য স্বাস্থ্য, তেমনি আধুনিকতার যে সব লক্ষণ ও দৃষ্টিভঙ্গির কথা আমরা আলোচনা করলাম তাও সাহিত্যকে গতানুগতিকতার হাত থেকে উদ্ধার করে নবতর রূপায়ণের ইঙ্গিতবহ মাত্র। লক্ষ্য সাহিত্য—প্রাচীন বা আধুনিক বিশেষণ বর্জিত সাহিত্য। বলা বাহুল্য, আধুনিকতার প্রয়োজন যেমন আছে তেমনি তার সীমাও আছে। এ সীমা সম্বন্ধে সচেতন না থাকলে আধুনিকতা ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে বাধ্য। প্রমাণের জন্য দূরে যেতে হবে না, বাংলা সাহিত্যে যারা এককালে ঘটা করে আধুনিকতার সূত্রপাত করেছিলেন ও হয়েছিলেন আধুনিক নামে পরিচিত, তাদের শোচনীয় পরিণতি দেখলেই তা বুঝতে পারা যাবে। যথেষ্ট শক্তি ও প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও এঁদের কেউ-ই প্রথম শ্রেণীর লেখক হতে পারেন নি। বড় জোর কেউ কেউ পেতে পারেন দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা। অনেকের ভাগ্যে তাও ঘটবে কি না সন্দেহ। দেখে অবাক লাগে–শেষ পর্যন্ত শৈলজানন্দ, প্রেমেন্দ্র মিত্রের মত প্রতিভারও অবলুপ্তি ঘটেছে সস্তা জীবিকার সিনেমা ও সিনেমা-সাহিত্যে। অচিন্ত্য সেনগুপ্তের পরিণাম আরো শোচনীয়। এ যুগে রত্নাকরের এমন দৃষ্টান্ত দ্বিতীয়টি মিলবে কিনা সন্দেহ। এক চরম থেকে আর এক চরমে–বেদে থেকে পরমহংসে এমন অবাধে বিচরণ, আধিভৌতিক থেকে আধিদৈবিকে আরোহণ না অবরোহণ!