কবিতা হিসেবে তাতে ত্রুটি নিশ্চয় ঘটেছে কিন্তু আবেদন হিসেবে তা যে হৃদয়স্পর্শী ও অতুলনীয় তাতে সন্দেহ নেই। তার ‘বর্তমান বিশ্বসাহিত্য’ নামক প্রবন্ধে তিনি সংক্ষেপে যেটুকু সাহিত্য পরিক্রমা করেছেন তাতে তার সচেতন মনের পরিচয় রয়েছে। আর সে পরিচয় মোটামুটি নির্ভুল।
তদুপরি নজরুল দেশের সীমিত পরিবেশে যুদ্ধপরবর্তী ঘটনা প্রবাহের যে এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ তাতেও সন্দেহ নেই। ফলে যুদ্ধের (প্রথম) পরপর বাংলা সাহিত্যে যে নতুন সুর, নতুন মন-মেজাজ ও ভঙ্গি দেখা দিল স্বাভাবতই তিনি হলেন তার পুরোধা ও মধ্যমণি। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার এক মনোজ্ঞ ছবি এঁকেছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তার ‘কল্লোল যুগে’। সে বই পড়লেও দেখতে পাওয়া যায় তার প্রধান সুর হচ্ছে নজরুলের সুর–সে বইয়ের আগাগোড়া ছড়িয়ে আছে নজরুলের ব্যক্তিত্ব, উপস্থিতি ও কণ্ঠস্বর। এমন কি ওই বইতে একক নজরুলের যত কবিতা বা কবিতাংশ উদ্ধৃত হয়েছে আর কারো তা হয় নি। সেদিনের আধুনিকতার ঢেউ শুধু কল্লোল, কালিকলম বা প্রগতিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। তবে অচিন্ত্যকুমার যে কয়জন লেখকের কথা প্রাধান্য দিয়েছেন তাদের কারো কারো মতো অন্যরা হয়তো পরবর্তী সাহিত্যে তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেন নি। হয়ত সেদিন দেশের ও বিদেশের ঘটনা প্রবাহের সর্বপ্লাবী গতিবেগ এমনি প্রচণ্ড ও দুর্বার ছিল যে তার প্রভাব কেউই এড়াতে পারেন নি। ফলে কলকাতার ও কলকাতার বাইরের আরো বহু পত্র-পত্রিকার পাতায় সেদিন আধুনিকতার সুর ধ্বনিত হয়েছিল। সে সবের ইতিহাস আজো অনুদঘাটিত। কল্লোল যুগের পরিধি লেখকের নিজের অভিজ্ঞতার সীমায় সীমিত। বলা বাহুল্য, লেখকের জন্য সেটাই যথার্থ। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার পুরোপুরি ইতিহাস লিখতে হলে সারা প্রদেশের সে যুগের সব পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত যে সব লেখায় আধুনিক ভাবধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে তারো খবরদারি ও মূল্যায়ন করতে হবে। এদিক থেকে কল্লোল যুগ’ বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার আংশিক ইতিহাস মাত্র। কিন্তু রচনাগুণে ও লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির আশ্চর্য প্রসারতায় ‘কল্লোল যুগ’ বাংলা সাহিত্যে যে একটি উল্লেখযোগ্য রচনার যুগ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ভাষা ও আন্তরিকতার এমন উচ্ছ্বসিত প্রকাশ কদাচিৎ দেখা যায়। ফলে পড়তে পড়তে মনে হয়–এ বই যেন মনের সব দরজা জানালা খুলে দিয়ে পাঠকের সঙ্গে কথা বলছে। এমন রচনা যে কোনো লেখকের পক্ষেই গৌরবের।
তিন
বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়ার পর নজরুল সৈনিক জীবন ছেড়ে দেশে ফিরে এলেন ১৯২০-এ অর্থাৎ কল্লোল বের হওয়ার তিন বছর আগে। মোসলেম ভারতের আবির্ভাব ওই বৎসরের বৈশাখ থেকে (বাংলা ১৩২৭)। তার প্রথম সংখ্যা থেকেই বের হতে লাগল নজরুলের পত্রোপন্যাস বাঁধনহারা। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার পরিপ্রেক্ষিতে এ নামটি লক্ষ করার মতো। কারণ, আধুনিকতার এক অর্থ সর্ববন্ধনমুক্তি অর্থাৎ ‘বাঁধনহারা’। পর বৎসর অর্থাৎ ১৩২৮-এর কার্তিক সংখ্যা মোসলেম ভারতে একই সঙ্গে বের হয় নজরুলের ‘বিদ্রোহ’ আর ‘কামাল পাশা’। কল্লোল বেরিয়েছিল ১৩৩০ এর বৈশাখে। কাজেই ‘কল্লোল’ বের হওয়ার প্রায় দেড় বছর আগে বাংলা সাহিত্যে সব কিছু না মানার, সব কিছু ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার যে দমকা হাওয়া তা বইয়ে দিল ‘বিদ্রোহী’। বাঁধনহারায় আধুনিকতার যেটুকু প্রভাতকলি ছিল ‘বিদ্রোহী’তে তাই তূর্য। ধ্বনি হয়ে ফেটে পড়ল। এভাবে নিজের অজান্তেই কল্লোলে বহু আগে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার ভিৎপত্তন করলেন নজরুল–পরবর্তীকালে ‘কল্লোল যুগে’র যিনি হলেন প্রধান ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে এও স্মরণীয়, নজরুল সম্পাদিত ধূমকেতুও বেরিয়েছিল কল্লোলের প্রায় আট মাস আগে। বলা বাহুল্য, কালিকলম ও প্রগতি বেরিয়েছিল আরো পরে (ধূমকেতু শ্রাবণ, ১৩২৯; কালিকলম বৈশাখ, ১৩৩৩; প্রগতি আষাঢ় ১৩৩৪)। কল্লোল বের হওয়ার আগে কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকদের ধূমকেতু কীভাবে উন্মাদ করে তুলেছিল তারও পরিচয় আঁকা আছে কল্লোল যুগে। কারণ সে যুগের তরুণ লেখকদের বহু আশা-আকাঙ্ক্ষা বিশেষ করে মন-মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গির খোরাক ধূমকেতুই তখন জোগান দিয়েছে। ধূমকেতু সাহিত্য পত্রিকা ছিল না সত্য কিন্তু সেদিনের বেপরোয়া বিদ্রোহ ও উন্মাদ যৌবন জলতরঙ্গের ভাষা আর বাহন ছিল ধূমকেতু। আর তা ছিল খাঁটি ও নির্ভেজাল। এ সত্যের জোরেই ধূমকেতু আকর্ষণ করেছিল রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের সানুরাগ সহানুভূতি।
‘বিদ্রোহী’ ও ধূমকেতুতে আধুনিকতার অনেক লক্ষণ ছিল বলেই তা সে যুগের তরুণ লেখকদের মনের পটভূমি রচনায় অনেকখানি সহায়তা করেছিল। পরে এসব লেখকদের অনেকেই সাহিত্যে আধুনিকতার আমদানি ও আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে হয়েছেন আধুনিক’ বলে চিহ্নিত। এমন কি জীবনানন্দ দাশের মতো বিশিষ্ট কবিও নজরুলের প্রভাব এড়াতে পারেন নি। নজরুলের তরঙ্গিত সত্তার স্পর্শ পেয়েছিলেন। কল্লোলের কবি জীবনানন্দ দাশ। তার ঝরা পালক গ্রন্থের একাধিক কবিতায় তিনি নজরুলের অনুকরণস্বাক্ষর রেখেছেন। [সঞ্জয় ভট্টাচার্য : আধুনিক কবিতার ভূমিকা।] আমাদের আধুনিক সাহিত্যের একমাত্র নজরুলই বলতে পারেন–‘I have come to. hold sacred, the disorder of my mind বিশৃঙ্খল মনের এমন পরিচয় আর কে দিয়েছেন, কোথায় মিলবে তার দ্বিতীয় নজির? ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটাইতো এ যুগের এক চলচ্চিত্র। আর এও স্মরণীয়, কল্লোল যখন বেরোয় নজরুল তখন জেলে আর সেখান থেকেই লিখে পাঠালেন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। ভাঙা ও গড়ার জন্য যে মুক্তি ও প্রবল আত্মবিশ্বাসের দরকার এক পরমাশ্চর্য উচ্ছ্বসিত ছন্দ ও ভাষায় তারই প্রথম জয় ঘোষণা শোনা গেল এ কবিতায়। যা চলতি তার পরিপন্থী হতে হলে অর্থাৎ হতে হলে বিদ্রোহী, চাই শক্তি ও প্রত্যয়, চাই সাহস; বরং বলা যায় সাহসের চেয়েও চাই বেশি দুঃসাহস। নজরুল এবং তার সমসাময়িক ও পরবর্তী অনেক আধুনিক লেখকদের সত্যি এসব গুণ ছিল। রুগ্ণ মন ও ক্ষীণ বলের পক্ষে বিদ্রোহী হওয়া সম্ভব নয়, সম্ভব নয় চলতি পথের পরিপন্থী হওয়া। বিদ্রোহের লক্ষণ ও লক্ষ্যের সমর্থনে জার্মান দার্শনিক নিটশে যা বলেছেন তা আমাদের বিদ্রোহী তথা আধুনিক লেখকদের বেলায়ও প্রয়োগ করা যায় :Objection, evasion, j yous distrust and love of irony are signs of health; everything absolute belongs to pathology. (Nietzche).। আমাদের আধুনিকদের রচনায় এসব লক্ষণের অভাব নেই এবং তারা শক্তিহীনও নন। যা আছে, যেমন ভাবে আছে, তাতে অভ্রান্ত মনে করে মেনে নেওয়া মনের সুস্থতার লক্ষণ নয়। এ হয়ত খাঁটি কথা। তবুও আশানুরূপ সাফল্য সাহিত্যে দেখা দিল না কেন? কেন ফলল না সাহিত্যে অদম্য উচ্ছ্বাস, শক্তির বেপরোয়া উল্লাস, সব কিছুর প্রতি অবিশ্বাস, তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ, নগ্ন সত্যভাষণ, বিদ্রোহ আর যা কিছু চলতি তার পরিপন্থী হওয়ার যে দর্শন–এসব প্রচুর শক্তি ও স্বাস্থ্যের লক্ষণ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সাহিত্য ও শিল্পে সাফল্য কি শুধু এর দ্বারা আয়ত্ত হতে পারে? সাহিত্য এক বিচিত্র ব্যাপার–জীবনের গভীরতর সত্যোপলব্ধি ও তার শিল্পোত্তীর্ণ প্রকাশ ছাড়া সাহিত্যে সাফল্য আশা করা যায় না। শুধু বিরুদ্ধতা, বিদ্রোহ, নবতর দৃষ্টিভঙ্গি বা ভাষা ও আঙ্গিকে চমক সৃষ্টি করে সাহিত্যে যেটুকু সাফল্য ও খ্যাতি তার আয়ু দীর্ঘ নয়।