দুই
সাহিত্যে আধুনিকতার পটভূমির কিছুটা পরিচয় পাওয়া গেল। তার লক্ষণ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিণাম ও পরিণতি কী ও কতটুকু তা বিচার করে দেখা উচিত।
আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘আধুনিক কাব্য পরিচয়’ পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেন : ‘দেখলুম তার অনেক কবিতাই আমাদের কালের হাট থেকে এসেছে। তার আকৃতি চেনা, তার প্রকৃতিও। তা হলে বলতে হবে আধুনিক কবিতা বহু প্রাচীন কাল থেকেই চলে এসেছে, কবির প্রেয়সী বুড়ি হয় না। এ সংকলন গ্রন্থে অনেক কবিতা দেখলুম যাতে কাল শিল্পী বিকৃতিকে নতুনত্ব বলে স্পর্ধা করেছে। বিকৃতি তার অস্বাভাবিকতা দ্বারা চমক লাগায়–যে জন্যে আপন পোষা জীব-জন্তুর মধ্যে ইচ্ছা করে মানুষ বিরূপের সন্ধান করে। অস্বাভাবিক আকষ্মিক, স্বাভাবিক চিরকালের। বিশেষ করে আধুনিকতার আদি যুগে লেখকরা ইচ্ছে করেই অস্বাভাবিক হতে চেষ্টা করেছেন, স্বাভাবিকতা ছেড়ে বিকৃতির করেছেন সন্ধান, করেছেন সাধনা। নূতন কিছু কররে ভাই নূতন কিছু করো’–এ ছিল একমাত্র মনোভঙ্গি। এখন জিজ্ঞাস্য: এটুকু পুঁজি সম্বল করে সাহিত্যের পথে কতটুকু এগিয়ে যাওয়া সম্ভব? আমাদের সাহিত্যের আধুনিক-চিহ্নিত কালের দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এতে সাহিত্যের তেমন কোনো স্থায়ী লাভ হয় নি। রবীন্দ্রনাথ যে স্বাভাবিকতার কথা বলেছেন তা অনুসরণ করে সাহিত্য যেমন একদিকে আধুনিক হতে পারে অন্যদিকে আধুনিক হয়েও হতে পারে ‘চিরকালের’। রবীন্দ্রনাথের নিজের রচনাতেই রয়েছে তার অজস্র দৃষ্টান্ত। চণ্ডালিকা, তাসের দেশ, রক্তকরবী, শেষের কবিতা, চার অধ্যায়–বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক আধুনিকতা চর্চার যুগেই রচিত, তখনকার সামাজিক, অর্থনৈতিক বহু সমস্যাই এসব রচনার উপকরণ ও প্রেরণা জুগিয়েছে। তা সত্ত্বেও এসব রচনা আধুনিকতার সীমা ডিঙিয়ে চিরকালের সাহিত্য হতে বাধা পায় নি–একবার পড়ে বা অভিনয় দেখে এসবকে বাতিল করে দেওয়া যায় না। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার ঢেউ অনুপ্রবেশের বহু আগে রবীন্দ্রনাথের যা কিছু সাহিত্যকর্ম তাতেও সমসাময়িক যুগ-জিজ্ঞাসা প্রতিফলিত হয়েছে–চোখের বালিতেই তো আধুনিক উপন্যাসের ভিতপত্তন। গোরা ও ঘরে বাইরেও সমকালের পটভূমিতেই বিধৃত। শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন পৃথিবীর তাবত বড় শিল্পীর রচনায় তাই ঘটেছে, কেউ যুগ বহির্ভূত বা যুগান্ধ ছিলেন না। গ্যেটে, টলস্টয়, শরৎচন্দ্র বা রোমা রোঁলা যার কথাই ধরা যাক না কেন–সবাই যুগপ্রতিনিধি হয়েও যুগাতীত। অর্থাৎ চিরকালের সাহিত্যই তারা রচনা করেছেন–শুধু সমসাময়িক কালের মধ্যে তাঁদের রচনা সীমিত হয়ে নেই। এঁদের সকলের রচনায় আধুনিকতা যে পর্যায় পরিমাণে স্থান পেয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবুও এদের শুধু আধুনিক বললে ছোট করা হয় না কি? এরা সর্বকালের, কেউই নন বাতিল বা বাসী অথবা পেছন তারিখ। সার্থক শিল্পীদের রচনা আধুনিকতার সীমায় আবদ্ধ নয় বলেই তারা কখনো সংকীর্ণ অর্থে আধুনিক নন। এমন কি যে সব রচনায় সমাজ জীবনের বিকৃত চেহারা ফুটে উঠেছে–যেমন ম্যাডাম বোভারি, লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার, ললিতা এসবও রচনা-গুণে সাহিত্যিক ও শিল্পানুগ ‘স্বাভাবিকতার’ জোরে আধুনিকতার সীমা ডিঙিয়ে চিরকালের সাহিত্য হতে পেরেছে। নিশ্চয় এসবের প্রেরণা ও উদাহরণ সমসাময়িক যুগ-ই যুগিয়েছে। এসব রচনা যা চলতি তারই তো পরিপন্থী।
নিঃসন্দেহে আত্মতৃপ্তি সাহিত্যের ও শিল্পের শত্রু। যে কোনো বড় শিল্পীর দিকে তাকালেই এ কথার তাৎপর্য বুঝতে বেগ পেতে হয় না। যা আছে তাকে নিয়ে কোনো বড় শিল্পীই সন্তুষ্ট থাকেন নি। বাংলা সাহিত্যে মধুসূদন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল–কেউই যা ছিল তাতেই শুধু ঘুরপাক খান নি; যা চলতি ও প্রচলিত রীতি, ভাবে ও আঙ্গিকে তাকে তারা অনায়াসে ডিঙিয়ে গেছেন। অনেকে ইচ্ছে করে সচেতনভাবে যে নতুন পথে পা বাড়িয়েছেন তা নয়, কালের হাওয়ার তরঙ্গাঘাত মনের তটে যে আলোড়নের সৃষ্টি করেছে তাতে তার সামনে পা না বাড়িয়ে পারেন নি। আজ দূরত্ব বলে কিছু নেই। পৃথিবীর দূরতম প্রান্তের ভাব-তরঙ্গও আজ এড়িয়ে যাওয়া কারো সাধ্য নয়। সমসাময়িক যুগের সব জিজ্ঞাসা ও প্রশ্নের সম্মুখীন, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সব শিল্পীকেই আজ হতে হচ্ছে। শরৎচন্দ্রের শেষ প্রশ্নও তো এমনি এক প্রশ্নের উত্তর সন্ধান। প্যাস্টারনেকের ডক্টর জিভাগো অন্য আর এক প্রশ্নের উত্থাপক ও তার জবাব-খোঁজা। রচনার জন্য জিজ্ঞাসা বা প্রশ্ন ও তার সমাধান বড় কথা নয়, রচনা সাহিত্য হয়েছে কি-না সেটাই বড় কথা। আধুনিক সাহিত্যকেও বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। বাংলা সাহিত্যের মহৎ শিল্পীরাও প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও সংস্কারের নিগড় ভেঙে সামনে অর্থাৎ নতুন পথে পা বাড়াতে দ্বিধা করেন নি এতটুকু। বলা বাহুল্য, এঁরা সবাই শুধু যে স্বদেশের ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন তা নয়, বিশ্বের ঘটনা প্রবাহের সঙ্গেও তাঁদের পরিচয় ছিল গভীর ও ব্যাপক। রবীন্দ্রনাথ তো খাঁটি অর্থেই বিশ্বনাগরিক ছিলেন আর নজরুল তো যুদ্ধ-ফেরত। অনেকের ধারণা, নজরুল সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্য সম্বন্ধে কোনো খবরই রাখতেন না। এ ধারণা ভুল। হয়ত গভীরভাবে কোনো সাহিত্যই তিনি অধ্যয়ন করেন নি, তবুও স্বাভাবিক প্রতিভা ও অদ্ভুত গ্রহণশীলতার ফলে অন্যান্য প্রতিভাবানদের মতো তিনি সামান্য পরিচয়কেও অসামান্য করে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। তার ‘সর্বহারা’ বা ‘সাম্যবাদী’ গুচ্ছের কবিতাগুলিও যে তার মার্কসিজম তথা কমিউনিজম সম্বন্ধে গভীর অধ্যয়নের ফল তা নয়–শোনা বুলি ও ভাসা ভাসা পরিচয়কে তিনি ওই সব রচনায় নিজের আবেগ দিয়ে অসামান্য করে তুলেছেন।