১৯৭১-এ বৃদ্ধ বয়সে চট্টগ্রামের নগর ও গ্রামে আত্মগোপন অবস্থায় লিখেছেন দুর্দিনের দিনলিপি (১৯৭২)–শান্তি, মুক্তি ও অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনার এক উজ্জ্বল দলিল।
শিক্ষাঙ্গনের এক নৈরাশ্যজনক ও চরম অবক্ষয়ী অবস্থার মধ্যে আবুল ফজল উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। গণ-টোকাটুকির জোয়ারে সেদিন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। আবুল ফজল অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সেই প্রবণতা মোকাবেলা করে সারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন। রাষ্ট্রপতির শিক্ষা উপদেষ্টা থাকাকালেও তিনি শেখ মুজিবের হত্যার পটভূমিতে একাধিক গল্প লিখে (মৃতের আত্মহত্যা [১৯৭৮] গ্রন্থে সন্নিবেশিত) শুধু সাহসিকতার পরিচয় দেন নি, হত্যার রাজনীতির প্রতি ধিক্কার বাণী উচ্চারণ করে পরিচয় দিয়েছেন সুষ্ঠু বিবেকের, পালন করেছেন দায়িত্বশীল বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা। এমন কি রাষ্ট্রীয় জীবনের শঙ্কাগ্রস্ত শৃঙ্খলিত মুহূর্তেও তিনি আমাদের সাহসের সমাচার শুনিয়েছেন। শাসকগোষ্ঠীর ত্রাসের রাজত্বের মুখে ভাষা আন্দোলনের মর্মবাণীকে তার মত কে এমন সাহসী ভাষায় স্পষ্ট করে তুলে ধরতে পেরেছেন–একুশ মানে মাথা নত না করা–এই নির্ভীক উচ্চারণের মাধ্যমে। বাংলাদেশের প্রগতিশীল লেখকদের মুখপত্র সমকাল স্বাভাবিক কারণেই তাকে ১৯৭৮ সালে ‘জাতির বিবেক’ অভিধায় ভূষিত করেছিল।
বস্তুত আবুল ফজল সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের একজন তীক্ষ্ণদৃষ্টি পর্যবেক্ষক ছিলেন। তাঁর প্রবন্ধ কিংবা দিনপঞ্জি এর স্বাক্ষর বহন করছে। জাতীয় জীবনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রতিটি সংকটে তিনি বিচলিত হয়েছেন, উদ্বিগ্ন হয়েছেন। এবং সাথে সাথেই তার মানস-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। শুধু এতেই তিনি ক্ষান্ত হন নি। সজাগ বুদ্ধিজীবীর স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে প্রত্যক্ষ ও ঋজু ভাষায় আপন সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন, সংকট উত্তরণের সম্ভাব্য পথ-নির্দেশ করেছেন। এবং এসব ক্ষেত্রে চাপ ও টোপ–দুটোকেই পরিহার করেছেন সাহস ও দৃঢ়তার সাথে।
যে কোন পরিস্থিতিতে বক্তব্যের স্পষ্টতা, মনোভাবের দৃঢ়তা, সুস্পষ্ট যুক্তিবাদী মনোভাব ও শঙ্কাহীন নিরঙ্কুশ সত্যভাষণ সমকালীন অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীর চেয়ে তাকে পৃথক ও বরেণ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। আর এভাবে তিনি জাতীয় বুদ্ধিজীবীর মর্যাদায় আসীন হতে পেরেছিলেন। আবুল ফজল সাহিত্যিক হিসাবে তার আপন ভূমিকার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন :
সাহিত্যকে আমি কোনদিন বিলাসের বস্তু মনে করি নি। মানুষের জীবনের, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সাহিত্যের এক বিশেষ ভূমিকা আছে। সে ভূমিকা সম্বন্ধে আমি সচেতন ছিলাম। তাই দেশের মানুষ ও সমাজের সমস্যা বার বার আমার লেখায় ছায়াপাত করেছে। ভয়ে বা প্রলোভনে আমি কখনো আমার কথাকে সাহিত্যের সত্যের পথ থেকে বিপথগামী হতে দিই নি। দেশ ও সমাজের কথা ভেবে যখনই আমার মন আলোড়িত হয়েছে তখন আমি তা নির্ভয়ে প্রকাশ করেছি–আমার কণ্ঠস্বর কখনো চাপা থাকে নি।
(সাহিত্যের পথ ও পাথেয়)
আবুল ফজল এ ক্ষেত্রে এক বর্ণও বাড়িয়ে বলেন নি। বুদ্ধির মুক্তি ও সমাজ প্রগতির আলোক শিখায় তাঁর জীবন ও সাহিত্য ভাস্বর। নিঃশঙ্কচিত্তে আমৃত্যু আবুল ফজল দায়িত্বশীল লেখকের ভূমিকা পালন করে গেছেন। প্রলোভন বা সন্ত্রাস–কোনো কিছুই তাকে বশীভূত করতে পারে নি। সত্যব্রতী দেশপ্রেমিক আবুল ফজল সব সময় বিবেকের কাছে মুক্ত থেকে। আপোসহীন মনোভাব নিয়ে জাতীয় সংকটের পথ-নির্দেশ করে যেভাবে সজাগ বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব পালন করে গেছেন সে জন্যে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ সব সময় তাঁর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবেন।
পাঁচ
আবুল ফজলের সমস্ত সৃষ্টিকর্মের পেছনে এক সুস্পষ্ট আদর্শ ক্রিয়াশীল ছিল। লেখকের নিজের ভাষায় যদি সে আদর্শকে চিহ্নিত করতে হয় তবে বলতে হয় সেটি মানবতন্ত্র, যার মূল কথা হলো, মানুষের মর্যাদার প্রতিষ্ঠা। রাজনৈতিক-দার্শনিক পরিভাষায় এর নাম উদার মানবতাবাদ। ওপর তলে মানুষের মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা, মানব কল্যাণ, মানুষের সর্বাঙ্গীন বিকাশ ও সমাজজীবনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি মানবতন্ত্রের অভীষ্ট। গভীরতলে শোষণ, অন্ধ বিশ্বাস ও প্রথানুগত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও প্রগতির পক্ষে দাঁড়ানোর ইতিবাচক সক্রিয়তা মানবতন্ত্রের প্রতিপাদ্য।
‘মানবতন্ত্র’ তথা মানুষের মর্যাদার জয়গান আবুল ফজলই যে প্রথম উচ্চারণ করেছেন তা নয়, কালে কালে যুগে যুগে মানুষের মহিমার সত্যভাষ্য ঘোষিত হয়েছে। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’–এই ধরনের মর্মবাণী অনেকেই উচ্চারণ করেছেন। এবং ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে দেখা যায়, দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিক দিক থেকে উদার মানবিকতার ধারণাটি স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে চতুর্দশ থেকে ষষ্ঠদশ শতকের ইউরোপীয় রেনেসাঁসের কালে। আর ঐ সময়-কালের মানবতাবাদীদের মধ্যে যারা বিশিষ্ট তাদের মধ্যে রয়েছেন ইতালির কবি দান্তে (১২৬৫-১৩২১), পেত্রার্ক (১৩০৪-১৩৭৪), ও বোকাচ্চিত্ত (১৩১৩-১৩৭৫), ইতালীয় চিত্রশিল্পী লেওনার্দো দা ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯), ইতালীয় বিজ্ঞানী-দার্শনিকব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০), ফরাসি লেখক সঁতেন (১৫৩৩-১৫৯২), পোলিশ জ্যোতির্বিদ কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩), ইংরেজ নাট্যকার শেকসপিয়র (১৫৬৪-১৬১৬), ইংরেজ দার্শনিক বেকন (১৫৬১-১৬২৬) প্রমুখ।