বর্তমান সভ্যতা কোনো গভীর ভাব ও চিন্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় বলে ক্রমবর্ধমান এত উন্নতি সত্ত্বেও পদে পদে ট্র্যাজিক পরিণতির হাত থেকে তা রেহাই পাচ্ছে না। আজ এই মহাসংকটের দিনে বাঁচতে হলে মানব সভ্যতাকে একটা নীতি ও সত্যের ওপর দাঁড় করাতে হবে। আর তা করাতে হলে মানুষকে ভাবতে হবে, করতে হবে চিন্তা ও যুক্তির চর্চা, হতে হবে বিবেকী।
[সভ্যতার সংকট’ প্রথম প্রকাশিত হয় আগামী (১৯৬৩) পত্রিকায়। পরে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন গ্রন্থে স্থান পায়।]
সমাজ ও সাহিত্যিক
সাহিত্যিক সমাজেরই অঙ্গ। সমাজেই তার উৎপত্তি, সমাজেই তার লয়। সমাজে ও সামাজিক প্রয়োজনেই হয়েছে ভাষার সৃষ্টি–যে ভাষা হচ্ছে সাহিত্যের বাহন, সাহিত্যিকের মন-মানসের মাধ্যমে।
সাহিত্যিক ছাড়া সমাজ কল্পনা করা যায়। কিন্তু সমাজ ছাড়া সাহিত্যিক কল্পনা করাই যায় না। ব্যষ্টি থেকে সমষ্টির তথা সাহিত্যিক থেকে সমাজের শ্রেষ্ঠত্ব তাই অনস্বীকার্য। সমাজ ছাড়া সাহিত্যিক, সাহিত্যিক হতে পারে না, পারেন না পা বাড়াতে জীবনে, এমন কি রচনায়ও তারা অচল হয়ে থাকতে বাধ্য। কারণ, তার কাঁচামাল অর্থাৎ রচনার উপকরণের একমাত্র সরবরাহ ক্ষেত্র হল সমাজ–সমাজিক মানুষ। তাই অন্যের বেলায় যেমন সাহিত্যিকের বেলায়ও তেমনি সামাজিক দায়িত্ব এক মহৎ কর্তব্য–বরং সাহিত্যিকের ওপর এই দায়িত্বের দাবি অধিকতর। কারণ, তার কার্যকারণ ও রচনার প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং তার প্রতিক্রিয়া দেশ-কাল-পাত্রকেও ডিঙিয়ে।
এখন জিজ্ঞাস্য, সাহিত্যিক আজ সামাজিক দায়িত্ব তথা নিজের সাধনা ও প্রতিভার প্রতি যে দায়িত্ব তা পালন করতে সক্ষম হচ্ছে কি না? পুরোপুরি দূরে থাক, আংশিকভাবেও পালন করতে সক্ষম হচ্ছেন কি না? বর্তমানে সমাজের রূপ এবং চেহারা যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, তাতে এই দায়িত্ব পালন সম্ভব কি না? সাহিত্যিকও মানুষ–সামাজিক মানুষ, একদম রক্ত মাংসের মানুষ। গজ দন্ত-মিনার’ কথাটা রূপকথার একটা উপমামাত্র, না হয় কোনো কালেই কোনো সত্যিকার সাহিত্যিক ‘গজ-দন্ত মিনার’বাসী ছিলেন না–অমন ভাগ্যবান ‘লাখে না মিলে এক’!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের নৈতিক মান অধঃপতনের পাতালপুরীতে গিয়ে ঠেকেছে। এই সর্বগ্রাসী অধঃপতনের হাত থেকে সাহিত্যিক-শিল্পীরাও আত্মরক্ষা করতে পারেন নি। বড় কারণ–জীবন সংগ্রাম অর্থাৎ দেহ-প্রাণ এক ঠাঁই রাখার যে প্রয়াস তা এক নিদারুণ রক্তক্ষয়ী ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। জীববিজ্ঞানের মূল কথা বেঁচে থাকার চেয়ে বড় ধর্ম আর নেই। এই বেঁচে থাকার ধর্মের কাছে অন্য সব ধর্ম–সত্য, ন্যায়, কল্যাণ ও সৌন্দর্য-সাধনা হার মানতে বাধ্য। তাই বেঁচে থাকার স্বভাবধর্ম পালন করতে গিয়ে সাহিত্যিকও আজ তাঁর সাহিত্যধর্ম বিসর্জন দিচ্ছেন অর্থাৎ দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
সাহিত্যিকের কাজ শুধু সমাজ-জীবনের রূপায়ণ নয়–মহৎ জীবনের মহৎ চিন্তা ভাবনার রূপায়ণও–সমাজকে অর্থাৎ সমাজের মানুষকে সত্য, ন্যায়, কল্যাণ ও সৌন্দর্যের তথা সর্বাঙ্গীণ সামঞ্জস্যের দিকে নিয়ে যাওয়া। এক কথায়, সুদৃঢ় সামাজিক ভিত্তির ওপর মানুষের মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলাই সাহিত্যিকের ধর্ম। সেই ধর্ম সাহিত্যিক আজ পালন করতে পারছে কি? যেখানে তার নিজের জীবনই সামঞ্জস্যহীন, ভারসাম্যহীন অবস্থা যেখানে সাহিত্যিককেও মনুষ্যত্বভ্রষ্ট করে ছেড়েছে, সেখানে সাহিত্য-ধর্ম পালনের কথা একটা হেঁয়ালির মত শোনায় না কি?
একদিন সুলতান মাহমুদের সামান্য মিথ্যাচারকে ফেরদৌসী ক্ষমা করেন নি। আত্মমর্যাদার এক অবিস্মরণীয় বিদ্যুৎ-ঝলক সেদিন দুর্ধর্ষ সম্রাটের রক্ত চক্ষুকে শুধু ঝলসে দেয় নি, নির্মম এ একচ্ছত্র রাজপ্রতাপকেও লাঞ্ছিত ও বিকৃত করে ছেড়েছিল। নিঃস্ব ফেরদৌসীর সাহিত্য-ধর্মের জয় এভাবে ইতিহাস বিশ্রুত হয়ে রয়েছে। এই নৈরাজ্যের যুগেও সত্যনিষ্ঠার মূল্য সমাজে স্বীকৃত হতো এবং সামাজিক পরিবেশ ছিল এর অনুকূল আর ফেরদৌসীর নিজের জীবন ছিল অকলঙ্ক সত্যের নিষ্কোষিত অসি তুল্য। তখন স্বভাব ধর্মের খাতিরে অর্থাৎ অন্নবস্ত্রের জন্যে সাহিত্যিককে পদে পদে সাহিত্য-ধর্ম বিসর্জন দিতে হতো না। তাই ফেরদৌসীর সাহিত্য-ধর্ম সেদিন নিছক বেঁচে থাকার স্বভাবধর্মকেও পরাস্ত করতে পেরেছিল। সমাজ ও সামাজিক পরিবেশই কি তার মনে এই দুর্জয় সাহস ও মেরুদণ্ডে ইস্পাতকাঠিন্য সঞ্চারিত করে দেয় নি? কারণ, কবি তো ভূঁইফোড় বা আকাশকুসুম ছিলেন না–ছিলেন সমাজেরই অঙ্গ, সমাজের সৃষ্টি ও সমাজেরই সন্ততি।
এখন সামাজিক অধঃপতনের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যিকদেরও চরম অধঃপতন ঘটেছে। তার জৈব-ধর্ম কীভাবে পদে পদে সাহিত্য ধর্মকে লাঞ্ছিত করছে তার দৃষ্টান্তের অভাব নেই। এ কারণেই নেহাৎ জৈব-ধর্মের তাড়নায় এখন বহু খ্যাতনামা সাহিত্যিককেও বিত্তবান ও ক্ষমতার অধিকারীকে বই উৎসর্গ করতে দেখা যায়। একজন সুপরিচিত সাহিত্যিক তো এক বহুনিন্দিত মন্ত্রীর জীবনী লিখতেই সংকল্প করে বসেছিলেন। কিন্তু কালচক্রে ও ঘটনাক্রমে যখন সে মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব আর রইল না সঙ্গে সঙ্গে উক্ত সাহিত্যিকের মন্ত্রী ভক্তিও একেবারে উবে গিয়ে শূন্যে মিলিয়ে যেতে একমুহূর্তও দেরি হলো না। সাহিত্যিকদের এসব কীর্তি নিছক গুণগ্রাহিতার পরিচয়–একথা মনে করলে মনকে। চোখ ঠারানো হবে। বলা বাহুল্য, সামাজিক অবস্থাই আজ সাহিত্যিককেও এভাবে মনকে চোখ ঠারাতে বাধ্য করছে। নেহাত অযোগ্য ও নানা সমাজ-বিরোধী কার্যকলাপে রত এমন ধনী পত্রিকা-মালিক ও প্রকাশকদের দুয়ারে সাহিত্যিকদের ধরনা দেওয়া, মাথা বিকানো তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এই অবস্থায় সাহিত্যিক সামাজিক দায়িত্ব কী করে পালন করবেন? কী করেই বা রক্ষা করবেন সাহিত্য-ধর্ম? আজ সমাজের কাছে। সাহিত্যিকের এই এক জিজ্ঞাসা।