৫০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলায় সাহিত্য-সংস্কৃতির স্বাভাবিক ও অবাধ বিকাশের পথে নানা অন্তরায় সৃষ্টি করে। জীবন-সত্য রূপায়ণ করতে গিয়ে শাসকগোষ্ঠীর বিষনজরে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। এই প্রেক্ষাপটে আবুল ফজল লেখেন সাহিত্যের সংকট প্রবন্ধটি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাজমান অস্থিতিশীলতা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বৈষম্য, ভৌগোলিক ব্যবধান, শাসক শ্রেণীর সাম্প্রদায়িক চরিত্র ইত্যাদি সংকট স্পষ্টভাবে অনুধাবন করে তিনি মন্তব্য করেন :
…আজ সাহিত্যিক, সাহিত্য প্রতিষ্ঠান, ও সাহিত্য সম্পর্কিত অনুষ্ঠানাদি এক অবাঞ্ছিত শিকারের লক্ষ্যবস্তু হয়ে পড়েছে। ফলে জাত লেখক ও সাহিত্যসেবীরা আজ অনেকটা দিশেহারা। সব দেশের মত আমাদের দেশেরও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জাতীয়তার সুষ্ঠু রূপ গ্রহণের ওপর নির্ভরশীল। এ যদ্দিন না হচ্ছে তদ্দিন। সাহিত্য ও সাহিত্যিকের দুর্গতির অবসান ঘটবে না।
(সাহিত্যের সংকট)
আবুল ফজল আধুনিকতাকে দেখেছেন আধুনিক মন ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টিশীল সংশ্লেষ হিসেবে। এর জন্য আধুনিক মনের সঙ্গে আধুনিক জীবন ও সমাজ-বাস্তবতার সংঘর্ষের ফলে। তার মতে, আধুনিকতায় সমসাময়িক যুগজিজ্ঞাসার প্রতিফলন যেমন প্রত্যাশিত তেমনি জোর করে আধুনিক হওয়ার চেষ্টায় নিছক চমক লাগিয়ে চোখ ভোলানোর চেষ্টাও নিন্দনীয়। তিনি বিশ্বাস করেন, আধুনিক শিল্পী যুগের সন্তান; তাঁর রচনার উপকরণ তিনি সংগ্রহ করেন যুগ থেকে, কাল থেকে; কিন্তু শিল্পীসত্তায় তাঁকে ছাড়িয়ে যেতে হয় যুগকে, কালকে। এ প্রসঙ্গে আবুল ফজল লিখেছেন :
আধুনিক হওয়ার সংকল্প নিয়ে কলম হাতে লিখতে বসলেই আধুনিক হওয়া যায় না–মনের ভিতর আধুনিকতার বোধ থাকা চাই অর্থাৎ কালের ধারাবাহিকতার বোধ। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের, বর্তমানের সঙ্গে ভবিষ্যতের যে অবিচ্ছিন্ন যোগসূত্র আছে তা কালের দিক থেকে যেমন সত্য তেমনি মানুষের শ্রেয়, সৌন্দর্য ও রসবোধের দিক থেকেও সত্য।
(সাহিত্যে আধুনিকতা)
সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে যারা সাহিত্যকে দেখেন আবুল ফজল কখনো তাদের দলে ছিলেন না। সমাজ ও সময়-লালিত ব্যক্তিমানুষের মতো সাহিত্যিকও যে সামাজিক মানুষ, সমাজজীবনের অনুষঙ্গে সাহিত্যিকেরও যে সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে আবুল ফজল কেবল মনে-প্রাণে তা বিশ্বাস করতেন না, বার বার সেকথা সাহিত্যিকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। শিল্পী-সাহিত্যিককে সমাজের বিবেক’ আখ্যায়িত করে তিনি লিখেছেন :
সাহিত্যিকের কাজ শুধু সমাজ জীবনের রূপায়ণ নয়–মহৎ জীবনের, মহৎ চিন্তা-ভাবনার রূপায়ণও। সমাজকে অর্থাৎ সমাজের মানুষকে সত্য, ন্যায়, কল্যাণ ও সৌন্দর্যের কথা সর্বাঙ্গীণ সামঞ্জস্যের দিকে নিয়ে যাওয়া। এক কথায়, সুদৃঢ় সামাজিক ভিত্তির উপর মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে ভোলাই সাহিত্যিকের ধর্ম।’
(সমাজ ও সাহিত্যিক)
সমাজ জীবনে সাহিত্যের ভূমিকা সম্পর্কে আবুল ফজলের ধারণা গভীর দেশপ্রেম প্রসূত। সে ধারণার মর্মবস্তু হচ্ছে :
ব্যক্তি, সমাজ, সম্প্রদায়, দেশ, জাতি, শাস্ত্র ও দেশাচারের হাজারো রকমের ভূত তথা সংস্কারের বন্ধনে মানুষের মন বাধা। ভয়, মোহ ও অহমিকা এ সব বাধনকে প্রায় অচ্ছেদ্য করে তোলে। সাহিত্য হচ্ছে এ বাঁধন কাটার মন্ত্র।
(সাহিত্যের পথ ও পাথেয়)
বিভিন্ন লেখায় ও ভাষণে আবুল ফজল বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন লেখক-শিল্পীর মহান দায়িত্বের কথা। বলেছেন, সাহিত্যিককে পলাতক আর দায়িত্বহীন হলে চলে না। তাকে হতে হয় সচেতন শিল্পী। রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক সংকট, শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখে শিল্পীমন সংকুচিত হতে পারে–এই আশঙ্কা দ্বারা ভাবিত হয়ে তিনি লেখক-শিল্পীদের হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, ‘শিল্পীর পক্ষে অজ্ঞতা ও ভয় দুই-ই শুধু মহা অপরাধ নয়–মহাপাপ।’
চার
আমরা আগেই বলেছি, আবুল ফজল কেবল কথা-সাহিত্যিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমাজসচেতন, উদার মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ববান, সৎ ও সাহসী বুদ্ধিজীবী। এ দেশের যে কোন সামাজিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংকটে তিনি অকুতোভয়ে সত্যের পক্ষে, যুক্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, দেশ জাতি-জনতার স্বার্থে কলম ধরেছেন। ১৯৫০-এর দাঙ্গার সময় সরকারি চাকুরে আবুল ফজল প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় নেমেছেন দাঙ্গার বিরুদ্ধে। ১৯৫১ সালে চরম সাম্প্রদায়িক উসকানির মুখে দৃঢ় ও বলিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়েছেন চট্টগ্রামে সংস্কৃতি সম্মেলন সফল করার জন্য। ১৯৬১সালে চট্টগ্রামে আয়ুব খানের সামরিক আইন উপেক্ষা করে যে অভূতপূর্ব উদ্দীপনার মধ্যে সপ্তাহব্যাপী রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হয় তাতে পালন করেছেন অগ্রণী ভূমিকা।
একাধারে কর্মী, সংগঠক ও লেখকের ভূমিকা পালন করেছেন আবুল ফজল। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর পর আবুল ফজল লেখেন তার বিখ্যাত প্রবন্ধ মানবতন্ত্র। এটি সমকাল পত্রিকায় (জ্যৈষ্ঠ ১৩৭১) প্রকাশের সাথে সাথে পত্রিকার সংশ্লিষ্ট সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। ষাট-এর দশকের মধ্যভাগে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের (১৯৬৫) পর আয়ুব-মোনেমের উসকানিতে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও রবীন্দ্রবিরোধী যে চক্রান্ত এ দেশে দানা বেঁধে উঠছিল আবুল ফজল তার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। সাংস্কৃতিক স্বাধিকার ও জাতীয়তার প্রশ্নে তিনি শুধু লিখে নয়, সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করে বাঙালি চেতনা ও ঐতিহ্যের সপক্ষে নিরন্তর লড়ে গেছেন। তাকে বিকশিত ও প্রসারিত করতে উদ্যোগী হয়েছেন।