[‘সংস্কৃতি প্রসঙ্গে’ বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সম্মেলেনে প্রদত্ত ভাষণ। প্রথম প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭২-এ। পরে তা শুভবুদ্ধি গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়।]
সংস্কৃতি
সংস্কৃতি সম্বন্ধে আমি কিছুমাত্র বিশেষজ্ঞ নই। বলা বাহুল্য, বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনা আমার পেশা আর ওই সাহিত্যে চর্চা যে আমার নেশা, তা আমার বন্ধুদের অজানা নয়। তবুও বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধেও আমি বিশেষজ্ঞ–এই দাবিও আমার পক্ষে অগ্রাহ্য ও অশোভন। সাহিত্যের তবুও একটা সুনির্দিষ্ট সীমানা আছে, তার নীতি ও ধর্ম অন্তত শিক্ষিত সমাজের জানা ও পরিচিত। তাই শিক্ষিত জনের সামনে সাহিত্যালাপ করা সহজ ও তাকে করা যায় বোধগম্য। কিন্তু সংস্কৃতি সম্বন্ধে কি এ কথা বলা যায়?
সংস্কৃতি শব্দটি চলতিও নয়, লৌকিকও নয়, ফলে তার সঙ্গে আছে আমাদের জনসাধারণের অপরিচয়। আমরা শিক্ষিতরা ওই শব্দটি ইংরেজি culture শব্দের অনুবাদ হিসাবেই গ্রহণ ও ব্যবহার করছি। বলা যায়, অপব্যবহার করছি সব চেয়ে বেশি। দেশে-বিদেশে এই শব্দের ব্যাপক অপব্যবহার কার না আজ লক্ষ্যগোচর? সংস্কৃতি কী, তার অর্থের গভীরতা ও পরিধি উপলব্ধি অধিকাংশ লোক করে না বলেই তার অপব্যবহার আজ এমন অবাধ ও সহজ হয়েছে। আমাদের চোখের সামনে দু দুটো প্রলয়ঙ্কর মহাযুদ্ধ ঘটে গেল, এ দুই মহাযুদ্ধে দুই বিপরীত পক্ষ তাদের যুদ্ধনীতির সমর্থনে দোহাই পেড়েছেন সভ্যতা ও সংস্কৃতির। ব্যাপক ও বেপরোয়াভাবে শুধু যুদ্ধক্ষেত্র বা সৈন্যবাহিনীর ওপর নয়, জনবহুল ঘুমন্ত নগরীর ওপর অকাতরে বর্ষিত হয়েছে মারাত্মক শেল, বোমা ও এটম বোম, দু পক্ষের মেশিনগানের গুলি থেকে রেহাই পায় নি নিরীহ শিশু ও নারী, বৃদ্ধ ও রুগ্ণ। এ সবই হয়েছে সভ্যতা ও সংস্কৃতির নামে। আমাদের দেশেরও অপেক্ষকৃত সঙ্কীর্ণতর ক্ষেত্রে যে নির্লজ্জ সাম্প্রদয়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে তারও পেছনে সক্রিয় প্রেরণা যুগিয়েছে ধর্মের নাম ও সংস্কৃতি সঙ্কট। ইউরোপ, আমেরিকা রাষ্ট্রকে সংস্কৃতি আর আমাদের দেশ সংস্কারকে সংস্কৃতি ধরে নিয়ে নিজেদের পশু-মানসের সমর্থন খুঁজেছে ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির আড়াল। আমার মতে, সংস্কৃতির–সত্যিকার সংস্কৃতির–কোনো ধর্মগত বা দেশগত রূপ হতেই পারে না, নাম আরোপও তেমনি শব্দের অপব্যবহার ছাড়া কিছুই নয়। ইউরোপীয় সংস্কৃতির কথা যখন আমরা বলি তখন আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ইউরোপের রাষ্ট্ররূপ, সেখানকার দেশাচার ও সংস্কার। তেমনি হিন্দু বা মুসলমান সংস্কৃতির কথা যখন বলি তখনো আমাদের চোখের সামনে তাদের সামাজিক আচার ব্যবহার, রীতিনীতি ও সংস্কারের ছবিই আমরা দেখতে পাই। ধুতি-চাদর পরা হিন্দু সংস্কৃতি নয়, কোনো কোনো হিন্দুর দেশাচার বলা যেতে পারে, আচকান-পায়জামা পরাও তেমনি মুসলিম সংস্কৃতি নয়। কোট প্যান্ট হ্যাটপরাও খ্রিস্টান বা ইউরোপীয় সংস্কৃতি নয়। এই সবই আচার–ব্যক্তিগত বা দেশগত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মগত। তেমনি দাড়ি রাখাও মুসলিম সংস্কৃতি নয়, তা যদি হত তা হলে পাকিস্তান মন্ত্রীসভার অধিকাংশকেই মুসলিম সংস্কৃতির দুশমণ বলতে হতো (বলা বাহুল্য, ধর্মীয় বিধান ও সংস্কৃতি এক কথা নয়)। শেভ করাও খ্রিস্টান বা ইউরোপীয় সংস্কৃতি নয়, তা হলে রাজা পঞ্চম জর্জ ও সপ্তম এডওয়ার্ড ও খ্রিস্টান পাদরিগণ ইউরোপীয় সভ্যতার শত্রুরূপেই গণ্য হতেন। যদি বলা হয়, লোকটি খুব cultured বা সংস্কৃতিবান তা হলে কারো মনে এমন কথা কি জাগে যে ক হচ্ছে হিন্দু বা মুসলমান বা খ্রিস্টান বা ক পরে হ্যাট, কোট বা আচকান-পাজামা বা ধুতি–চাদর? বা ক মাংসাশী কি নিরামিষভোজী? অথবা ক যায় মসজিদে, কি মন্দিরে অথবা গীর্জায়? বা ক হচ্ছে বি.এ. পাস কি এম. এ. পাস? কখখনো নয়। তা হলে বুঝতে হবে যে সব দেশগত বা রাষ্ট্রগত বা ধর্মগত বা সম্প্রদায় ও দলগত আচার-ব্যবহার, মতামত ও রীতি-নীতিকে আমরা সংস্কৃতি বলে পরিচয় দিয়ে নিজদের কার্যকলাপের সমর্থন খুঁজি, তা আসলে সংস্কৃতি নয়। তা যদি হত তবে উত্তম হ্যাট, কোটধারী বা দামি শেরওয়ানি পরুয়া বা মূল্যবান গরদের ধুতি-চাদর পরিধানকারী কখনো বর্বরের মত আচরণ করত না এবং এম.এ. বা পিএইচডি ডিগ্রিধারী কখনও করত না অসভ্যের মতো ব্যবহার। তাই আমাদের বক্তব্য রাষ্ট্র বা সংস্কার যেমন সংস্কৃতি নয়, তেমনি প্রচলিত ধর্মীয় আচার বা শিক্ষাও সংস্কৃতি নয়। পৃথিবীতে এমন কোনো ধর্ম নেই, যে ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে অসভ্যের দেখা মিলবে না এবং অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত লোককেও নেহাত পাষণ্ডের মত ব্যবহার করতে কে না দেখেছে? কাজেই ইসলাম, হিন্দু, খ্রিস্টান বা অন্য যে কোনো ধর্মগ্রহণ করেও লোক uncultured থাকতে পারে, তেমনি এম.এ. পাস করে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো উচ্চতম ডিগ্রি নিয়েও uncultured থাকা অসম্ভব নয়।
সংস্কৃতি ও সভ্যতা কী জিনিস তা না জেনেই আমরা বিশেষ বিশেষ সভ্যতার প্রতি আগ্রহ ও পক্ষপাত দেখিয়ে থাকি। এই ভাবে আমাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয় বলেই আমরা সংস্কৃতির আসল স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারি না। সংস্কৃতির প্রতি যার সত্যিকার দরদ রয়েছে, তিনি কখনও সংস্কৃতির নামে সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় গ্রহণ করতে পারেন না। যদি কেউ এরকম করেন তিনি কখনও cultured বা সংস্কৃতিবান নন।