এ বক্তব্যের আলোয় আমরা ধর্মস্থান আর ধর্মপ্রধান বা ধর্মপ্রাণ দেশগুলির দিকে তাকালে বুঝতে পারবো কেন সেখানে শুধু মহৎ ট্র্যাজেডি নয়, এমন কি কোনো ভালো নাটক, নভেল বা উচ্চাঙ্গের সংগীত কিংবা নৃত্যকলারও সৃষ্টি হয় নি। আমাদের দেশেও এমন কি উচ্চাঙ্গের ইসলামি সংগীত যারা রচনা করেছেন তারাও প্রচলিত অর্থে উচ্চাঙ্গের ধার্মিক ছিলেন না। ধর্ম অপ্রয়োজনীয় বা মানবজীবনে তার কোন মূল্য নেই–তেমন কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার বক্তব্য, ধর্মকে ধর্মের এলাকায় সীমিত রাখাই সঙ্গত–আর সাহিত্য-শিল্প তথা সাংস্কৃতিক সাধনাকে দেওয়া উচিত মানবজীবনের বিচিত্র রহস্য সন্ধানের পুরোপুরি সুযোগ ও স্বাধীনতা। যারা ধর্মকে মানুষের জীবনের একমাত্র অবলম্বন বা সারাক্ষণের বস্তু মনে করেন–আমার বিশ্বাস, মানবজীবন তথা মানবচরিত্র সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণাই নেই। যে মানুষ উদয়াস্ত সারাদিন তসবিহ জপেই কাটিয়ে দেন তিনি কি কখনো পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারবেন? এমন মানুষের দ্বারা দেশের সমাজের ও রাষ্ট্রের কি কিছুমাত্র ফায়দা হবে? চারদিকে পৃথিবীব্যাপী আমরা সভ্যতার যে বিচিত্র উপকরণ দেখছি তার কোন কিছুই এসব ধার্মিকের অবদান নয়। বরং এর অনেক কিছুর সঙ্গে ধর্মের বিরোধ রয়েছে। সিনেমা টেলিভিশনকে ধর্ম-সম্মত প্রমাণ করতে হলে ধর্মের কাটাটাকে ইচ্ছামতো মোচড়াতে হবে! আমার বিশ্বাস, জীবনের আনন্দবেদনাকে উপেক্ষা করে কোন ধর্মপ্রবর্তকও এভাবে জীবন কাটান নি বা কাটাবার নির্দেশ দেন নি। আমাদের দেশে যারা ধর্মের কথা বলেন, তারা আনুষ্ঠানিক ধর্মের বাইরে মানব-জীবন, মানবচরিত্র ও মানবস্বভাবের কোন খোঁজই রাখেন না। তাই এ সবের বিকাশ কী করে ঘটে সে খবরও তাঁদের অজানা। এরা ধর্মকে ধর্মের জন্য ব্যবহার করেন না,তদুপরি ধর্মকে এরা ব্যবহার করেন জাগতিক স্বার্থ লক্ষ্য করেই। এঁদের উপেক্ষা করে চলা ছাড়া শিল্পী আর সংস্কৃতিসেবীদের অন্য কোনো উপায় নেই। বিবাদে লিপ্ত হওয়া মানে অযথা নিজের শক্তি ক্ষয় করা। বলা বাহুল্য, মহৎ শিল্পীমাত্রই বিদ্রোহী। শিল্পীর এ বিদ্রোহী সত্তার সম্বন্ধেও আমাদের সব সময় সচেতন থাকতে হবে। যুগে যুগে বিদ্রোহী পথেই শিল্পের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। আমাদেরও এ পথ, ঐতিহ্যের নামে সংস্কারের নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে থাকলে আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না সংস্কৃতিচর্চার পথে এক পাও এগিয়ে যাওয়া। ফলে আমাদের দেশ, আমাদের যুগ বন্ধ্যা হয়েই থাকবে–ভবিষ্যতের হাতে আমরা কিছুই তুলে দিতে পারবো না। শুধু গ্রহীতা হয়েই থাকবো, দাতার ভূমিকা আমাদের ভাগ্যে কখনো জুটবে না। কোনো দেশ বা জাতির পক্ষে এ ভূমিকা যে–সৌন্দর্যের পসরা খুলে দেয় তাতে মন আমাদের উন্নত হয়, রুচি হয় মার্জিত, পাই আমরা এক অনির্বচনীয় আনন্দের স্বাদ। তা ছাড়া, আরো একটি বিশেষ ভূমিকা আছে সাহিত্য আর শিল্পের। বাইরের বন্ধন মানুষ সহজেই কাটতে পারে কিন্তু মনের বন্ধন কাটাই কঠিন। যে শত্রুকে দেখা যায় তার সঙ্গে মোকাবিলা সহজ, কিন্তু অদৃশ্য আর অশরীরী শত্রুই সাংঘাতিক। দিনের আলোয় যারা ভূতের অস্তিত্বেই বিশ্বাস করে না, রাতের অন্ধকারে তেমন মানুষকেও ভূতের ভয়ে দুরু দুরু বুক হতে দেখা যায়। মানুষের মনোরাজ্যে আর তার দিগদিগন্তে সাহিত্য আর ললিতকলা হচ্ছে দিনের আলো, দিনের আলোরও বেশি; কারণ দিনের আলোতেও যেসব ভূত পালায় না, এ সব শিল্পের আলোয় সে সব ভূতও পালাবার পথ খোঁজে। মানুষের মনে কতরকম ভূতের যে আড্ডা তার কোন ইয়ত্তা নেই–ব্যক্তি, সমাজ, সম্প্রদায়, দেশ, জাতি শাস্ত্র ও দেশাচারের হাজারো রকমের ভূত তথা সংস্কারের বন্ধনে মানুষের মন বাধা। ভয়, মোহ ও অহমিকা এ সব বাঁধনকে প্রায় অচ্ছেদ্য করে তোলে। সাহিত্য আর সব রকম শিল্পসাধনা হচ্ছে এ বাঁধন কাটার মন্ত্র। এ সব বাধন কাটাতে পারলে মুক্তবুদ্ধির দিনের আলোয় বিচরণ হয় সহজ। শিল্পসাধনাও হয় তখনই সার্থক। প্রকৃত cultured বা সংস্কৃতিবান হওয়ার এ-ই পথ।
দেশের সংস্কৃতিসেবীরা অনেক বাধা-বিঘ্ন আর দুঃখ-দুর্দশার শিকারে পরিণত। তবুও বলবো মানবাত্মা অজেয়–শত বাধা-বিঘ্ন আর নির্যাতনেও তার পরাজয় নেই। এ বিশ্বাসের জোরেই মানুষ মৃত্যুঞ্জয়। এ বিশ্বাস মানুষের এক পরম সম্পদ। এ সম্পদ পড়ে পাওয়া বস্তু নয়, প্রতিদিনের সাধনা ও অনুশীলনের দ্বারা এ সম্পদকে জয় করতে হয়, রাখতে হয় সজীব আর সচল। এ রাখার জন্যই সংস্কৃতি-সাধনা–সব রকম ভয় ভীতিকে উপেক্ষা করে অবিচলিত চিত্তে তাতে আত্মনিবেদন করা।
[‘সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তা’ প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় সমকালীন চিন্তা গ্রন্থে।]
সংস্কৃতি প্রসঙ্গে
স্বাধীনতার পর আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের গতি-প্রকৃতি আর তার রূপরেখা সম্বন্ধে দেশের বুদ্ধিজীবীদের মনে স্বভাবতই নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। স্বাধীনতার পূর্বে অর্থাৎ ১৯৭১-এর মার্চের আগে সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে আমাদের যা অবস্থা ছিল স্বাধীনতার পর তার তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে কি না, যে পরিবর্তনকে নিঃসন্দেহে চিহ্নিত করা যায় অগ্রগতি বলে–এটি আমাদের সামনে এক বড় জিজ্ঞাসা।