তিন
আবুল ফজলের লেখক প্রতিভার সম্যক স্ফুরণ ঘটেছে তার প্রবন্ধে। সেখানে একজন ঋজু, মননশীল, সৎ, সাহসী, মানবতাবাদী প্রাবন্ধিকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে সাহিত্য ও সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, ধর্ম ও রাজনীতি, মানবকল্যাণ ও মানবমুক্তি–এ সব বিষয়ে তিনি ভাবুক মন নিয়ে লিখেছেন এবং সব ক্ষেত্রেই তার ভূমিকা একজন সমাজসচেতন লেখকের।
আবুল ফজলের প্রথম প্রবন্ধ গ্রন্থ বিচিত্র কথা (১৯৪০)। আর জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ প্রবন্ধ গ্রন্থ হচ্ছে, নিবাচিত প্রবন্ধ সংকলন (১৯৮১)। এ দুইয়ের মাঝখানে প্রকাশিত তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধ গ্রন্থ হচ্ছে : সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা (১৯৬১), সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন (১৯৬৫), সমাজ সাহিত্য রাষ্ট্র (১৯৬৮), সমকালীন চিন্তা(১৯৭০), মানবতন্ত্র (১৯৭২), শুভবুদ্ধি (১৯৭৪), সাহিত্য ও অনান্য প্রসঙ্গ (১৯৭৪), একুশ মানে মাথা নত না করা (১৯৭৮), রবীন্দ্র প্রসঙ্গ (১৯৭৯), সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধাবলী (১৯৮০)। এসব প্রবন্ধে তার ভাবনা-চিন্তা, মানসিকতা, ধ্যান-ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে।
আবুল ফজলের প্রবন্ধের একটা উল্লেখযোগ্য পরিসর দখল করে আছে তার সাহিত্য ভাবনা। সাহিত্য-বিষয়ক প্রবন্ধে তিনি অবশ্য সাহিত্যতত্ত্ব আলোচনায় ততটা আগ্রহী নন; বরং তার অন্যান্য রচনার মতোই এগুলি দিক-নির্দেশনামূলক ফলাকাঙ্ক্ষী রচনা। সাহিত্যক্ষেত্রে সমকালীন সমস্যা ও তার অভিপ্রেত ও প্রত্যাশিত সমাধান-নির্দেশ করে বুদ্ধিজীবীর কর্তব্য সম্পাদনই সেগুলির লক্ষ্য।
অগ্রসর বুদ্ধিজীবী হিসেবে আবুল ফজলের এই ভূমিকা স্পষ্টতই লক্ষ করা গিয়েছিল পাকিস্তানের জন্মলগ্ন (১৯৪৭) থেকে। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের ধর্ম ও সম্প্রদায়ভিত্তিক তথাকথিত সাহিত্যিক ঐতিহ্য গড়ে তোলার এবং বাংলা ভাষার হাজার বছরের ঐতিহ্য অস্বীকার করার যে প্রবণতা সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠী মদদ যোগাচ্ছিল আবুল ফজল তার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি দ্বিধাহীন ভাষায় উচ্চারণ করেছিলেন : দেশের ঐতিহ্য। ও বিশ্বসাহিত্যের ঐতিহ্য–এ দুয়ের মিলনভূমির উপর হবে নতুন ঐতিহ্যের গোড়াপত্তন। আবুল ফজল শুধু যে নিজে সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন তা নয় তিনি সেদিন দেশের সাহিত্যিকদের সামনে একজন সত্যিকার পথনির্দেশকের এবং অকুতোভয় বুদ্ধিজীবীর ভূমিকার অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ‘সাহিত্যের ঐতিহ্য’ প্রবন্ধে এ প্রসঙ্গে তার সুস্পষ্ট পথ-নির্দেশ :
কালের ক্ষয় ও বিচার পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে যে সব সাহিত্য-শিল্প মানুষের চিরন্তন ঐতিহ্যে পরিণত, তা যে দেশের, যে জাতের, যে ভাষারই হোক না কেন সাহিত্যিকের কাছে তা কিছুতেই উপেক্ষণীয় হতে পারে না। ধর্ম বা সম্প্রদায়ের নামে অথবা জাতি কি ভাষাগত কারণে সাহিত্য-শিল্পের স্মরণীয় ঐতিহ্য বিশেষকে উপেক্ষা করা মানে নিজের শিল্প সাধনাকে খর্ব করা, ছোটর জন্য বড়কে ত্যাগ করা।
তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, সাহিত্যের নীতি বা চরিত্র কোনো ক্রমেই সাম্প্রদায়িক বা দলীয় প্রকৃতির হতে পারে না। তাই সাহিত্যিকদের কাছে তিনি দাবি করেছেন সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি :
জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের ফলে এখন সব দেশের মানুষের মনের পটভূমি অন্তত এক হয়ে যাচ্ছে। আমাদেরও আয়ত্ত করতে হবে সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি, করতে হবে বিশ্বসাহিত্যের খবরদারি।
(সাহিত্যের ঐতিহ্য)
পাকিস্তানি আমলে ধর্মের নামে, তথাকথিত জাতীয় আর্দশের ধুয়া তুলে সাহিত্যিকদের উপর স্বরাষ্ট্র বিভাগের জবরদস্তি চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা হলে আবুল ফজল তীব্র ভাষার এর প্রতিবাদ করেন। আপোসহীন মনোভাব নিয়ে লেখেন :
সাহিত্যিকের কাছে সত্যই বড়ো কথা। সত্যের সঙ্গে যদি জাতীয় আদর্শ, ধর্ম ও শাস্ত্রের বিরোধ ঘটে, নিঃসন্দেহে বিনা দ্বিধায় সাহিত্যিক সত্যের পক্ষাবলম্বন করবে।
স্বৈরাচারী কায়েমি স্বার্থবাদী শাসক-চক্রের নির্দেশে সে সময়ে এক শ্রেণীর জি-হুজুর সাহিত্যিক যখন নিজের দেশ, মাটি, ঐতিহ্য ও পরিবেশকে অস্বীকার করে আরব-বাগদাদ মিশর প্রভৃতি অঞ্চলের পরিবেশকে এ দেশের সাহিত্যের উপকরণ করার মানসিকতা পোষণ করেছিল, তখন আবুল ফজল সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন :
আমাদেরও সাহিত্যের প্রাণরস স্বদেশের মাটি থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। সব বড় সৃষ্টিরই বুনিয়াদ দেশের মাটি ও প্রকৃতি। এমন কি ধর্মগ্রন্থগুলিও তার ব্যতিক্রম নয়। …পূর্ববঙ্গের পাঠকদের কাছে ফোরাত, দুজলা, বসফোরাস অপেক্ষা পদ্মা, কর্ণফুলী, বুড়িগঙ্গা অনেক বেশি সত্য; আরাফাতের মাঠে থেকে রমনার মাঠ অনেক বেশি প্রত্যক্ষ।
(কথা সাহিত্যের কথা)
তাই বলে এ কথা ভাবলে ভুল হবে যে, ইসলাম ধর্ম বা ঐতিহ্যের উপাদানকে আবুল ফজল সাহিত্যের উপাদান হিসেবে উপেক্ষা করতে চেয়েছেন। বরং তিনি মনে করেন, অন্যান্য ধর্মের ওপর সাহিত্যের আধিপত্য বিস্তৃত হলেও ‘ইসলামের ধর্মীয় ও আধা-ধর্মীয় ঘটনা ও কাহিনীগুলি এখনো যথাযথভাবে সাহিত্য-শিল্পের উপকরণ হতে পারে নি সামাজিক গোঁড়ামি ও অসহিষ্ণুতাই এর কারণ’ (সাহিত্য ও শিল্পের উপেক্ষিত উপকরণ)। তিনি দুঃখ করে বলেছেন, ‘মুসলমানদের শিল্পবোধ ও সৃষ্টিপ্রতিভা অন্য কোনো রকমে মুক্তি না পেয়ে তা শুধু মসজিদ আর স্মৃতিসৌধেই চুড়ান্ত রূপ নিয়েছে’ (সাহিত্য ও শিল্পের উপেক্ষিত উপকরণ)। তিনি এসব উপকরণকে যুগোপযোগী আঙ্গিকে রূপ দেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।