১. বাংলা ভাষার প্রতি এক ধরনের বিরূপ মনোভাব;
২. শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত ইত্যাদির চর্চায় অংশগ্রহণকে মুসলমানদের পক্ষে না-জায়েজ গণ্য করা;
৩. নারীসমাজকে পর্দার অন্তরালে আবদ্ধ রাখা;
৪. যুক্তিবাদী মনোভাবের পরিবর্তে অন্ধ বিশ্বাস, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও প্রথানুসরণের মনোভাব নিয়ে জীবন ও জগৎকে দেখা; এবং
৫. উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ইত্যাদি।
শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানদের একটা অংশের মধ্যে সাধারণভাবে এই বিশ্বাস ও ধারণা তখন প্রচলিত ছিল যে, মুসলমানদের বাংলা ভাষা শেখার দরকার নেই। ইংরেজির মতো বিদেশী ভাষা কিছুতেই শেখা উচিত নয়। কিন্তু আরবি ভাষা অবশ্যই শেখা চাই। এমন কি আবুল ফজলের আলেম পিতা যখন শুনেছিলেন, আবুল ফজল লিখতে চান, তিনি আরবি, ফারসি কিংবা উর্দুতে লেখার পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে উর্দু ভাষাকে নিজের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার যে উৎকট প্রবণতা সে-সময় আবুল ফজল লক্ষ করেছিলেন ১৯২৬ সালের দিকে লেখা ‘মাতৃভাষা ও বাঙালি মুসলমান’ প্রবন্ধে তার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন। ঐ প্রবন্ধে তিনি যে শুধু শ্লেষাত্মক ভাষায় সকল বিভ্রান্তির মূলে কুঠারাঘাত করেছিলেন তা নয়, বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা কী সে বিষয়েও নির্দ্বিধায় সঠিক মত ব্যক্ত করেছিলেন :
‘বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কী? উর্দু না বাংলা? আমার মতে ইহাই সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত কথা। আম গাছে আম ফলিবে না কাঁঠাল–এমন অদ্ভুত প্রশ্ন অন্য কোনো দেশে কেহ করিয়াছেন কি না জানি না।’
(তরুণপত্র, শ্রাবণ, ১৩৩২)
ধর্মের নামে শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত চর্চা ও আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ থেকে সেদিন যে বাঙালি মুসলমান নিজেদেরকে স্বেচ্ছায় দূরে রাখতে প্রয়াসী হয়েছিল তার জন্য আবুল ফজলের দুঃখের সীমা ছিল না। তার চৌচির (রচনা ১৯২৭, প্রথম প্রকাশ ১৯৩৪) জীবনপথের যাত্রী (১৯৪৮) ইত্যাদি উপন্যাস এ বেদনারই ফসল। চৌচির উপন্যাসের নায়ক তসলিম বিদেশে জাদুঘরে চিত্র দেখে মুগ্ধ হয়ে যে আত্মবিশ্লেষণ করে তাতে আমরা আবুল ফজলের চিন্তারই প্রতিফলন দেখতে পাই :
মানুষের চিন্তা, অনুভূতি ও ভাবধারা প্রকাশের একমাত্র বাহন যে চিত্র-শিল্প, তা কি মানুষের ধর্ম ইসলাম হারাম করিতে পারে?… এ আমাদের ইসলামকে বুঝিবার ও বুঝাইবার ভুল….। এটা হারাম, ওটা না-জায়েজ, এই করিয়া বিশ্বের এই জ্ঞানের অভিযানে আধুনিক মুসলমান তাহার হক আদায় করিতেছে না। এই জন্য একদিন তাহাকে পস্তাইতে হইবে।
পর্দার অন্তরালে নারীসমাজের বন্দিদশা সে সময়ে সাহিত্যচর্চার পথে কীভাবে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আবুল ফজল সে কথা শুধু লেখেন নি, তিনি সকলকে এ বিষয়েও সজাগ করে তুলেছিলেন যে, এই অবরোধ প্রথা সমাজপ্রগতির পথেও বাধার বিন্ধ্যাচল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবরোধবাস থেকে নারীসমাজকে মুক্ত করার জন্যে সক্রিয় আন্দোলনেও শরিক হয়েছিলেন। তিনি। পর্দাবিরোধী সংঘের (Anti Purdah League) সদস্য হয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের এক সভায় (১৯২৫) পঠিত ‘পর্দা প্রথার সাহিত্যিক অসুবিধা’ প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছিলেন যে, পর্দাপ্রথা। তথা নানা বিধি-নিষেধের বেড়াজালে বাঙালি মুসলমান নারীসমাজ বন্দি বলে নারীর জীবন সম্পর্কে লেখকরা ছিলেন অজ্ঞ। অথচ নরনারীর চির রহস্যময় সম্পর্কই সাহিত্যের অন্যতম প্রধান উপকরণ। ফলে তিনি সহজেই এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, পর্দাপ্রথা মুসলমান সাহিত্যিকদের সাহিত্য সাধনার পথে বিশেষ অন্তরায়। কথাসাহিত্যের চর্চার মুসলমানরা কেন এগিয়ে আসতে পারছেন না–সে প্রসঙ্গে নিজের অভিমত ব্যক্ত করে তিনি লিখেছিলেন :
মুসলমান সাহিত্যিকের জন্য মুসলমান সমাজের কল্পলোকের রঙমহল আজ তালাবন্দি, তাই আমাদের দ্বারা যথার্থ সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে না–যা হচ্ছে তা হয় অসম্ভব কল্পনা না হয়। পরানুকরণ।
(পর্দাপ্রথায় সাহিত্যিক অসুবিধা)
ধর্মান্ধ মোল্লা-মৌলবিরা তাদের সংকীর্ণ চিন্তা ও সীমাবদ্ধ শিক্ষা দিয়ে ধর্মীয় বিধি-নিষেধের যে বিশাল পাঁচিল তুলে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাজগৎকে তার মধ্যে আবদ্ধ করতে চেয়েছিল–তা লক্ষ করেও আবুল ফজল মর্মাহত হয়েছিলেন। তাই তিনি চেয়েছিলেন, বাঙালি মুসলমানের চেতনার জাগরণ ঘটিয়ে বিশ্বের মানবধর্মের সাথে তার মিতালি রচনা করতে। তাঁর প্রথম উপন্যাস চৌচির রচনার পেছনে কাজ করেছিল এই বোধ। কিন্তু তারও আগে ‘ইসলাম কী জয়’ রচনায় তিনি ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও অন্ধ বিশ্বাসের অন্তঃসারশূন্যতার স্বরূপ উদঘাটনের জন্য কলম ধরেছিলেন। ঐ প্রবন্ধ তিনি লেখেন :
বিশ্বাস করিয়া সুখ আছে জানি, কিন্তু সত্যের সন্ধানে বা সত্যকে আবিষ্কার করিয়া মানুষের যে সুখ, যে আত্মপ্রসাদ তাহার তুলনা নাই। অনুসন্ধানের ভিতর দিয়া সত্যে পৌঁছার পথে বাধার সৃষ্টি করা হইলে তাহাতে ক্ষতি ছাড়া কোন লাভ হয় না।
এভাবে লেখক জীবনের শুরু থেকেই আবুল ফজল এক মহৎ সামাজিক দায়িত্ব পালনের ব্রত নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। এবং যতই অগ্রসর হয়েছেন ততই তার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্র ক্রম-প্রসারিত হয়েছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই তিনি দৃষ্টিপাত করেছেন দায়িত্ববান সজাগ লেখকের মতো। তবে আবুল ফজলের ভূমিকা মূল্যায়নে। এ কথা কটিই শুধু যথেষ্ট নয়। কারণ তিনি নিজে যে শুধু সমাজ-সচেতন লেখকের দায়িত্ব। পালন করেছেন তা নয়, অন্যান্য লেখককেও দায়িত্ব-সচেতন করে তোলার প্রচেষ্টা ছিল তার। বরাবর। এখানেই অন্যান্য লেখকের সাথে তার সুস্পষ্ট পার্থক্য।