১৯২৮ সালে বি. এ. পাশ করার পর আবুল ফজল কলকাতায় যান আইন পড়তে। তবে আইন ব্যবসায়ে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় বলে বাবা বাদ সেধেছিলেন। আবুল ফজল এ যুক্তি মানতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত আইন পড়াও হয় নি। বাবার ইচ্ছাকেই মান্য করেছিলেন। অবশ্য আইন পড়তে যাওয়াটা তার একেবারে বিফলে যায় নি। কলকাতায় থাকা কালে তিনি মাসিক সওগাত পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। এই সূত্রে কলকাতার সাহিত্য-জগতের সঙ্গে আবুল ফজলের যে পরিচয় ঘটেছিল তাঁর সাহিত্যিক মানসগঠনে তার ভূমিকাও কম নয়। এখানেই তিনি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩), মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী (১৮৯৬-১৯৫৪), গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪), আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৭-১৯৭৯), আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭-১৯৭৮) প্রমুখ সমকালীন খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের সাহচর্যে আসেন। এই সময়ে সওগাত পত্রিকায় তার কয়েকটি লেখাও প্রকাশিত হয়। কিন্তু বাবা ছিলেন বাংলা লেখার ঘোর বিরোধী। কীভাবে আবুল ফজল নাম ভাঁড়িয়ে বাবার রোষের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলেন তার বর্ণনা আছে তার আত্মচরিতমূলক গ্রন্থ রেখাচিত্রে (১৯৬৬)।
১৯২৯-এর জুলাইয়ে আবুল ফজল ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে বি.টি পড়ার জন্যে ভর্তি হন। ১৯৩০-এ ছয় মাসের জন্য চাকরির সুযোগ পান ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের একটা অস্থায়ী পদে। পাশাপাশি তিনি আবার মুসলিম সাহিত্য সমাজের কর্মতৎপরতায় ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হন। ১৯৩০-এ পালন করেন ঐ সংগঠনের সম্পাদকের দায়িত্ব।
১৯৩১-এ আবুল ফজল বি.টি, পাশ করেন। ১৯৩২-এ চট্টগ্রামের কাজেম আলী স্কুলে অস্থায়ীভাবে শিক্ষকতা শুরু করেন। ঐ বছরই সীতাকুণ্ড নিউ স্কিম মাদ্রাসায় হেডমাস্টার পদে যোগ দেন। এর পর থেকে দীর্ঘ জীবন তিনি নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৩-এ সরকারি চাকরিতে যোগ দেন খুলনা জেলা স্কুলে। ১৯৩৭-এ বদলি হয়ে এসে যোগ দেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে।
অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৯০-১৯৭৭) সঙ্গে যোগাযোগ করে আবুল ফজল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনিয়মিত প্রার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে ১৯৪০ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম. এ. পাশ করেন। এরপর ১৯৪১-এ কৃষ্ণনগর কলেজে বাংলার শিক্ষক হিসেবে তার অধ্যাপনা জীবনের শুরু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি চলে আসেন চট্টগ্রাম কলেজে (১৯৪৩)। এখান থেকেই ১৯৫৯-এ তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন।
তার অবসর গ্রহণ উপলক্ষে চট্টগ্রামের নাগরিকদের পক্ষ থেকে ড. মুহম্মদ এনামুল হকের (১৯০৬-১৯৮২) সভাপতিত্বে তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা প্রদান করা হয় (১৯৫৯)। ১৯৬২ সালে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি প্রেসিডেন্টের রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত হন। ঐ বছরই ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষে চট্টগ্রামে সাড়ম্বরে তার হীরক জয়ন্তী উদ্যাপিত হয়। ১৯৬৫-তে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি তাকে মুক্তবুদ্ধির চির সজাগ প্রহরী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ১৯৬৬-তে তিনি লাভ করেন আদমজী সাহিত্য পুরস্কার।
শিক্ষাবিদ হিসেবেও আবুল ফজল প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫) অনুরোধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সম্মানসূচক ডি. লিট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বছর খানেক রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেন বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি থাকাকালে (১৯৭৬-১৯৭৭)। তবে রাষ্ট্রীয় আদর্শ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দেওয়ার কারণে মতান্তর হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করে ফিরে আসেন চট্টগ্রামে। এখানেই সাহিত্য সাধনায় আত্মনিয়োজিত থাকাকালে ৪ঠা মে ১৯৮৩ স্বগৃহ ‘সাহিত্য নিকেতনে’ প্রায় ৮০ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
দুই
আবুল ফজল উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, অনুবাদ ও আত্মজীবনীমূলক রচনা মিলিয়ে প্রায় ৬০টি গ্রন্থ লিখেছেন। তাঁর পরিচয় তিন গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার। কিন্তু সৃজনশীল সাহিত্য-শিল্পী হিসেবে তাঁর যে পরিচিতি সে পরিচয় তার সব পরিচয় নয়। পেশাগত দিক থেকে এবং জাতীয় সমাজ-জীবনে ভূমিকা মিলিয়ে তিনি একজন শিক্ষাবিদও। কিন্তু এর চেয়ে বড়ো পরিচয়ও তার আছে। তিনি সমাজ-সচেতন সাহসী বুদ্ধিজীবী, জাতির বিবেক।
আর সেই কারণেই দেখা যায়, দীর্ঘ আট বছরের নিরলস সাহিত্য-সাধনায় যে বৈচিত্র্যময় প্রচুর ফসল তিনি আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন সে-সবের সর্বত্রই আমরা একজন সমাজ সচেতন, দায়িত্ববান, সজাগ লেখকের নিরবচ্ছিন্ন উপস্থিতি লক্ষ করি। বুদ্ধির মুক্তি ও সমাজ প্রগতির যে শিখায় তাঁর অন্তরজগৎ উদ্ভাসিত হয়েছিল তারই প্রোজ্জ্বল প্রতিফলন ঘটেছে তার সাহিত্যে। শুধু সৃষ্টিশীল সাহিত্যে নয়, তার মহৎ ভাবনায়, তার বাস্তব কর্মকাণ্ডে তিনি পালন করেছেন সজাগ বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব।
লেখক জীবনের শুরু থেকেই আবুল ফজলের মধ্যে সামাজিক সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য-সাধনার পথে যে-সব বাস্তব অন্তরায় সেদিন বিরাজ করছিল ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি সেসব চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। সেই সঙ্গে এগিয়ে এসেছিলেন সেসব অপসারণের চেষ্টায়। তার সজাগ দৃষ্টি ও মহান ব্রত তাকে এক্ষেত্রে সহায়তা করেছিল। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে সাহিত্য-সাধনার পথে বিরাজমান যে সব বাধাকে আবুল ফজল চিহ্নিত করেছিলেন, তার মধ্যে রয়েছে :