১৯০৩ সালের ১ জুলাই (তার পিতার একটি ডায়েরি থেকে জানা যায়, তার সঠিক জন্ম তারিখ ১৭ জুলাই] দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার কেঁউচিয়া গ্রামে এক নিম্ন-মধ্য পরিবারে প্রথিতযশা সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আবুল ফজলের জন্ম। তার বাবা মৌলভি ফজলুর রহমান ছিলেন আলেম এবং প্রায় তিন দশক ধরে চট্টগ্রাম জামে মসজিদের পেশা-ইমামের দায়িত্ব পালন কালেই ১৯২৯ সালে তার মৃত্যু হয়। মা গুলশান বেগম ছিলেন গৃহবধূ।
গ্রাম্য মক্তবে আবুল ফজলের পড়ালেখায় হাতেখড়ি। ১৯১৩-য় চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকানন। উচ্চ বিদ্যালয়-সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কয়েক মাস পড়ার পর ধারাবাহিকভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেছেন চট্টগ্রাম সরকারি নিউ স্কিম মাদ্রাসায় (১৯১৪-১৯২২)। সেখান থেকে প্রবেশিকা (১৯২৩) এবং চট্টগ্রামের ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে হাজী মুহাম্মদ মুহসীন কলেজ) থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার (১৯২৫) পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি. এ. ক্লাসে ভর্তি হন।
আলেম পরিবারে জন্ম এবং লেখাপড়ার ভিত্তি মাদ্রাসায় হলেও ছেলেবেলা থেকেই নানা বিষয়ে কৌতূহল ও সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ পারিবারিক পরিবেশের সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করে মুক্ত-মানস গঠনে আবুল ফজলকে সহায়তা করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি বিখ্যাত বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে (১৯২৬-১৯৩১) আকৃষ্ট হন এবং এতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সে আন্দোলনের মূল কথা ছিল, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ’কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই আন্দোলন। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল সেদিনকার বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বিভ্রান্তির চোরাবালি থেকে উদ্ধার করে তাদের চৈতন্যে নবজাগরণের জোয়ার সৃষ্টি। চৈতন্যের পশ্চাৎপদতা, সংস্কারবদ্ধতা, ধর্মান্ধতা ও কূপমণ্ডুকতার মত অবক্ষয়ী মূল্যবোধের স্বরূপ উন্মোচন করে এই আন্দোলন বাঙালি মুসলমানের মধ্যে সঙ্কীর্ণতামুক্ত উদার মানবিকতা, মুক্তবুদ্ধি, অসাম্প্রদায়িকতা, প্রগতিশীল চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উদ্বোধন ও বিকাশে প্রয়াসী হয়েছিল। এই আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা হিসেবে আবুল হুসেন (১৮৯৬-১৯৩৮), কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০), কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪), মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩ ১৯৬৫) প্রমুখের সঙ্গে আবুল ফজলও উপলব্ধি করেছিলেন, কেবল ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল নয়, ধর্মীয় গোঁড়ামি, সংস্কারাচ্ছন্নতা, সঙ্কীর্ণ মনোবৃত্তি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যবাদ ও সামাজিক অশিক্ষা কুশিক্ষার এক বিশাল অচলায়তনে বাঙালি মুসলমানের মানবিকতাবোধ ও সুস্থবুদ্ধি বন্দি হয়ে আছে। বুদ্ধির মুক্তি ঘটাতে না পারলে বিভ্রান্তির চোরাবালি থেকে তাদের উদ্ধার করা যাবে না। এভাবেই কিছু সংখ্যক তরুণ মুসলমান প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীর সাথে একত্রে আবুল ফজল আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মানস-আকাশে এক প্রগতিশীল ধারা রচনা করেছিলেন। এই আন্দোলনের মুখপত্র শিখা (১৯২৭-১৯৩১) গণমুখী সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সংগঠক ও অন্যতম রূপকার হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং শিখা পত্রিকারসম্পাদনা (১৯৩১) আবুল ফজলের মনোজাগতিক পালাবদলে পালন করেছিল অনুঘটকের ভূমিকা। এই আন্দোলনের চেতনার শিখাঁটিকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন।
আবুল ফজল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ ১৯৪১) এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে তিনি ‘The Philosophy of Art’ এবং ‘What is Art’ শিরোনামে দুটি বক্তৃতা দেন (৭ই ফেব্রুয়ারি ১৯২৬)। আবুল ফজল কবির বক্তৃতা শুনে এবং ঘরোয়া আলাপে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়ে উদ্বুদ্ধ ও যারপরনাই প্রভাবিত হয়েছিলেন।
যতদূর জানা যায়, ছাপার অক্ষরে আবুল ফজলের প্রথম রচনা ‘একটি আরবী গল্প’। আরবি সাহিত্যের খ্যাতনামা লেখক আবু মোহাম্মদ আল কাসেম ইবনে আলী আল হাবিবী-র লেখা একটি গল্পের এই অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল কল্লোল পত্রিকার কার্তিক ১৩৩০ সংখ্যায়। তার প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ-–’হজরত মোহাম্মদের উদারতা’। এটি প্রকাশিত হয় প্রাচী পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩৩০ সংখ্যায়। তবে ভারতবর্ষ পত্রিকার মাঘ ১৩৩০ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বাহাই ধর্ম’ প্রবন্ধটি আবুল ফজলের লেখক জীবনের প্রথম দিকে লেখা উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। এসব প্রবন্ধ তিনি লেখেন ছাত্রাবস্থায়।
১৯২৭-২৮-এ লেখা হয় আবুল ফজলের প্রথম উপন্যাস চৌচির। ১৯২৮ সালে ঢাকা। থেকে প্রকাশিত শান্তি পত্রিকায় এই উপন্যাসের কিছু অংশ ছাপা হলেও পুরোটা ছাপা হয়। ১৯২৯-এ সওগাত পত্রিকায়। এ উপন্যাস পড়ে পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ পত্রালাপে। ‘মুসলমান সমাজের সমস্যা’ ও ‘সমাজের অন্তরের দিক’ জানার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন (৬. ৯. ১৯৪০ সালে লেখা পত্রটি ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে)।