আজ প্রায় সব সভ্য রাষ্ট্রই বিশ্ব জাতি সংস্থার (U. N. O) সদস্য আর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ সব আইন কোনো ধর্ম শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসরণ করে রচিত হয় নি–রচিত হয়েছে আধুনিক জীবনের চাহিদা ও প্রয়োজনানুসারে এবং এসবই আধুনিক রাষ্ট্রীয় আর্দশ ও ধারণার পরিপূরক। ইংল্যান্ডের রাজা বা রাণী খ্রিস্টান, অধিকাংশ নাগরিকও খ্রিস্টান–এ অজুহাতে হঠাৎ যদি সেখানে আইন করা হয় যে, সব ইংরেজকেই প্রতি রবিবার গির্জায় হাজির হতে হবে এবং মানতে হবে যিশুখ্রিস্ট ঈশ্বরের সন্তান তা হলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অধিকাংশ ইংরেজ শুধু যে বিদ্রোহ করবে তা নয়–আন্তর্জাতিক আদালতে এ আইনের বিরুদ্ধে নালিশও উঠতে পারে। সে আদালতের অধিকাংশ বিচারক খ্রিস্টান হলেও তাতে বাইবেলের নির্দেশ যে হালে পানি পাবে না। তাও সুনিশ্চিত। ভারতে হিন্দু ধর্মানুসারে পূজা-অর্চনা আর পাকিস্তানে নামাজ-রোজা আইনের সাহায্যে বাধ্যতামূলক করলেও একই অবস্থার বরং এর চেয়েও খারাপ অবস্থার সম্মুখীন হতে হবেই। আসল কথা, এ যুগে কোনো রাষ্ট্রই ধর্মভিত্তিক হতে পারে না, পারবে না। করতে গেলেই ধর্মকে ফাঁকি ও গোঁজামিলের আড়ালে মুখ ঢাকতে হবে। তাই আমার বিশ্বাস, ধর্ম ও তার ফাঁকি ও শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ নিয়ে আধুনিক কোনো রাষ্ট্রই হালে পানি পাবে না। দুষ্টান্ত আগেও দিয়েছি, আরো দিচ্ছি। সুদ, প্রাণীর ছবি, মদ, বেশ্যা–এ সবই কোরান-হাদিসে সুকঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মুসলিম বা ইসলামি রাষ্ট্র’ হয়েও পাকিস্তানে এ সব রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। রাষ্ট্রীয় অনুমতি ছাড়া নগ্ন বা অর্ধনগ্ন কোনো ছবিই আমদানি করা যায় না, তেমনি লাইসেন্স ছাড়া মদ আমদানি বা বিক্রিও অসম্ভব। বহু শহরে-বন্দরে যে সব বেশ্যা নিবাস রয়েছে তাও রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা স্বীকৃত–অনুমোদিত। বলা বাহুল্য, এ সবই আধুনিক রাষ্ট্রের অনুষঙ্গ। ধর্মের দোহাই বা নির্দেশ এগুলিকে কিছুতেই বাতিল করতে পারে না। পারলে রাষ্ট্রের নামের সঙ্গে ‘ইসলামি’ বিশেষণ যোগ করার আগে পাকিস্তানে কোরান-হাদিসের বরখেলাপকারী সব কিছুকে নিশ্চিহ্ন করা উচিত ছিল। তা করা কি সম্ভব? ( রাষ্ট্রীয় দফতর থেকে যে খতিয়ান বের হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানের মদের পরিমাণ বছর বছর বেড়েই চলেছে–সরকারি অনুমতি ছাড়া একি সম্ভব?) তা করতে হলে সমস্ত পৃথিবীটাকেই নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে–করতে হবে নতুন সমাজ বিন্যাস, বিশেষ করে বর্তমান অর্থনীতিকে বদলাতে হবে গোড়া থেকে আগা অবধি। বর্তমানে স্বাধীন দুনিয়ার কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে এ করার ক্ষমতা আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে পাকিস্তানের যে সে ক্ষমতা নেই সে সম্বন্ধে আমি সুনিশ্চিত।
কোরান-হাদিসের বাইরে যে ইসলাম, সে ইসলাম সম্বন্ধে আমার ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। আমার ধারণা সত্য, ন্যায়, সামাজিক সুবিচার, ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সাম্য ইত্যাদি যে সব বড় বড় বুলি শোনা যায় এর কোনোটাই ইসলামের একচেটিয়া নয়। সব ধর্ম ও সব রাষ্ট্রেই এগুলি স্বীকৃত–এমন কি কাফিরি রাষ্ট্রেও ‘মিথ্যা’ শুধু নিন্দনীয় নয়, দণ্ডনীয়ও। খ্রিস্টানি মুলুক ইংল্যান্ড-আমেরিকা আজ ‘মাঙ্গলিক’ দেশে পরিণত, যেখানে ধনী-দরিদ্র কারো চিকিৎসার খরচ লাগে না। আর পাকিস্তানে ইসলামের সামাজিক ন্যায় বিচার এখনো রাষ্ট্রবিদদের উচ্চরোল বক্তৃতা আর কেতাব-কোরানেই সীমাবদ্ধ। চিকিৎসার মতো মানবীয় ব্যাপারেও পাকিস্তানে ধনী-দরিদ্রের সুযোগ-সুবিধার আসমান-জমিন পার্থক্য বোধ করি কারো নজর এড়ানোর কথা নয়। ইসলামি ভ্রাতৃত্ব, ইসলামি সুবিচার ইত্যাদি জীবন ও বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন বড় বড় বুলি না আউড়িয়ে যা কিছু সর্বমানবীয় সত্য তার দিকে আমাদের রাষ্ট্রের পদক্ষেপ হলে একই সঙ্গে রাষ্ট্র ও নাগরিক উভয়েরই মঙ্গল হতো। তা ছাড়া ছোট-বড় সব বুলিই ফাঁকা ও ফাঁকি হতে বাধ্য। কারণ তার সঙ্গে ব্যবহারিক জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। কথার বাইরে তার অস্তিত্ব অনুপস্থিত।
‘স্বর্গ-রাজ্য’, ‘ধর্ম-রাজ্য’, ‘রাম-রাজ্য’, ইত্যাদি বহু বুলিই শোনা গেছে। এ সবের কী অর্থ আমি প্রশ্ন করে এ যাবৎ কোন সদুত্তর পাই নি। যারা এ সব বুলি আওড়ান তাদের নিজেদেরও এ সব বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ও সঠিক ধারণা নেই। ঢাকায় একবার এক সেমিনারে জনৈক সুপণ্ডিত অধ্যক্ষ এক প্রবন্ধ পড়েছিলেন। প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে আশা প্রকাশ করেছিলেন—’অচিরে পাকিস্তান স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে।’ সভাশেষে তাকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম–ভাই, স্বর্গরাজ্য কাকে বলে? তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চেয়েই রইলেন আমার দিকে, কোনো উত্তরই দিতে পারলেন না। মোট কথা, স্বর্গরাজ্য সম্বন্ধে তার নিজেরই কোনো ধারণা নেই–না থাকারই কথা। স্বর্গরাজ্য আমি যেমন দেখি নি তিনিও দেখেন নি। একটা ‘পবিত্র আশা’ প্রকাশ করতে হবে তাই করা। আসলে ওই বুলি একটা আকাশকুসুম মাত্র। ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ কথাটাও যাঁরা বলেন তাদের মনেও ওই রাষ্ট্র সম্বন্ধে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা যে আছে তা নয়, তারাও ওই শব্দ দুটির আড়ালে আর এক রকম আকাশকুসুমেরই চাষ করে থাকেন। এর সঙ্গে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ জড়িত রয়েছে বলে আপাতত এর চাষ জমছে ভালো।