কাজেই এক অলঙ্ঘনীয় সীমা ও গণ্ডি টেনে দেওয়া হয়েছে মানুষের সামনে–ধর্মের ক্ষেত্রে এর বাইরে পা বাড়াবার অধিকার মানুষের নেই। এর ভালোমন্দ যাচাইয়ের বা এ-সম্বন্ধে মতামত দেওয়ার অধিকার থেকেও মানুষ বঞ্চিত। ধর্মের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে এক ও সুনির্দিষ্ট। আমার যতটুকু ধারণা, ধর্মের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য মানুষের মনে আধ্যাত্মিক চেতনা জাগিয়ে তোলা, তাকে ভেতরে-বাইরে সৎ ও আল্লাভক্ত রূপে গড়ে তোলা। ‘সৎ’ কথাটা নিয়েই মুশকিল। আধ্যাত্মিকতা বা আল্লা ভক্তি এমন একটা অশরীরী ব্যাপার যে তাকে ধরা-ছোঁওয়া, দেখা-শোনা, বাছ-বিচার কী পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায়–কিছুতেই আনা যায় না।
এ সব ক্ষেত্রে শুধু মানুষ, সমাজ বা রাষ্ট্রকে যে ফাঁকি দেওয়া যায় তা নয়, নিজের মনকেও চোখ ঠারানো যায় সহজে। কিন্তু সৎ ও সজ্জীবনের দাবি এমনি প্রত্যক্ষ ও লক্ষ্যগোচর যে, তাতে নিজেকে কিছুটা ফাঁকি দেওয়া গেলেও সচেতন মানুষ বা সমাজকে ফাঁকি দেওয়ার কোনো উপায়ই থাকে না। লোকটা সৎ কিনা, সঞ্জীবন যাপন করে কিনা তা সহজেই বিচার করে দেখা যেতে পারে। কারণ, সঞ্জীবন ব্যক্তিবিশেষের ব্যবহারিক জীবনেরই ফুল। কিন্তু আধ্যাত্মিকতা বা খোদাভক্তির ব্যাপারে তা কি বলা। যায়? যে লোক আল্লার একত্বে আর নবীদের প্রেরিতত্বে বিশ্বাস করে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, রমজানে রোজা রাখে, সামর্থ থাকলে কোরবানি আর হজ্ব করে ও যাকাত দেয়–তাকে প্রচলিত অর্থে ধার্মিক বা খোদাভক্ত বলে স্বীকার করতেই হয়। কিন্তু এমন লোক সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় অর্থে সৎ নাও হতে পারে। নিরপেক্ষ বিচারে এমন লোকও কি অহরহ দণ্ডিত হচ্ছে না? অর্থাৎ দণ্ডের উপযুক্ত অপরাধ কি করছে না? মানুষকে ধার্মিক বা খোদাভক্ত করে তোলার জন্য প্রত্যেক ধর্মেই নির্দিষ্ট বিধি-বিধানের ব্যবস্থা আছে, যারা তা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে তাদের ধার্মিক বা খোদাভক্ত না বলে উপায় নেই কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে পালনীয় নীতি-নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পর্কহীন এই আনুষ্ঠানিক স্বধর্মনিষ্ঠার মূল্য কতটুকু? আমাদের প্রত্যেক কোর্ট-কাছারির সঙ্গে বা ধারে কাছে এক বা একাধিক মসজিদ আছে। এসব মসজিদে যাদের নিয়মিত দেখা যায় তাদের অনেককে আবার আসামির কাঠগড়ায়ও কি দেখতে পাওয়া যায় না? এও কি এক রকম গোঁজামিলের। ফল নয়? রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এ গোঁজামিলের নজির আরো ব্যাপক। উদাহরণ দিয়ে নিজের ও সমকালের বিপদ ডেকে আনতে চাই না। আগে যে একবার দেহের মায়ার কথা বলেছি হয়ত সে মায়ায় আমিও এখানে গোঁজামিল দিতে বাধ্য হচ্ছি। মোটকথা ধর্মে, সাহিত্যে, রাষ্ট্রে সর্বত্রই আজ গোঁজামিলের রাজত্ব। আমরা যারা লিখে থাকি আমরাও, গোঁজামিল দিয়ে দিয়েই লিখি। আনুষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে সঞ্জীবনের মিল হলে তা যে সোনায় সোহাগা হয় তাতে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সোনার সঙ্গে সোহাগ মেশাবে কে? রাষ্ট্র? এটিই আমার এক বড় প্রশ্ন। রাষ্ট্র যদি যে অন্ধ আবেগের কথা সূচনায় বলেছি, তার খপ্পরে পড়ে এ দায়িত্ব গ্রহণে এগিয়ে আসে–সে দায়িত্ব রাষ্ট্র আদৌ পালন করতে পারবে কিনা, পারা সম্ভব কিনা? পারলে কতটুকু পারবে? এসব সঙ্গত প্রশ্নের উত্তরের সম্মুখীন না হয়ে এড়িয়ে চললে অধিকতর গোঁজামিলের আশ্রয় নিতে আমরা বাধ্য হবো। তাতে ধর্ম বা রাষ্ট্র কারো ফায়দা হবে না। মানুষ হবে নাজেহাল।
ধর্ম এক নয়, কিন্তু এখন সব সভ্য ধর্মই স্রষ্টার একত্বে বিশ্বাস করে। তবে এ একত্বের স্বরূপ ভিন্নতর। মুসলমানের আল্লাহ্ সম্বন্ধে ধারণা ও উপলব্ধির সঙ্গে হিন্দুর ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণা ও উপলব্ধির যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে, তেমনি খ্রিস্টানদের গডের ধারণা আর উপলব্ধিও অন্যরকম। আবার বৌদ্ধরা তো বুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো অশরীরী শক্তিকেই আমল দেয় না। সম্ভবত এক সৌদি আরব ছাড়া পৃথিবীতে এমন কোনো রাষ্ট্র নেই যেখানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোক বাস করে না। আশ্চর্য এমন সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সৌদি আরব তাদের রাষ্ট্রের নামের আগে ‘ইসলামি’ বিশেষণ যোগ করে নি। ইসলামের জন্মস্থান ও তার ধর্মীয় কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও আরবের রাজা ও রাজকুমারদের জীবনযাত্রার যে সব চমকপ্রদ কাহিনী শোনা যায় ও কাগজপত্রে পড়া যায় তা আংশিক সত্য হলেও তার সঙ্গে ইসলামের বিধি-বিধানের বিশেষ যে মিল নেই তা সহজেই অনুমেয়। তাঁদের জীবন আর ধর্মের মধ্যে যে আত্মবিরোধ রয়েছে তারা হয়ত তা বুঝে গোঁজামিলের শিকার হতে চান নি। এটুকু আন্তরিকতা আর কাণ্ডজ্ঞানের জন্য তারা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য।
গণতন্ত্র মানে সংখ্যা। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করতে গেলে নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের যে ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বেশি তাদের ধর্মানুসারেই রাষ্ট্রকে গড়ে তুলতে হবে। সে ধর্মই হবে রাষ্ট্রের ধর্ম–রাষ্ট্রীয় আদর্শের প্রতিভূ। সে হিসেবে পাকিস্তানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র বিশেষিত করা সঙ্গতই হয়েছে। কিন্তু নামকরণ এক কথা আর নামের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে বাস্তবায়িত করা অন্য কথা। যে কোনো নাস্তিকেরও নাম নূরুল ইসলাম কি শামসুল ইসলাম হতে পারে; কিন্তু তাই বলে নামের বরকতে সে যে একদিন পাকাপোক্ত মুসলমান হয়ে উঠবে এমন ভবিষ্যদ্বাণী কি করা যায়? খোদাবক্সও যে খোদাভক্ত হয় না তার নজির দেদার। বিশেষত, রাষ্ট্র একটি সমষ্টিগত ব্যাপার, অগণিত মানুষের জীবনের সঙ্গে তার সম্পর্ক। আর আজকের দিনের কোনো সভ্য রাষ্ট্রই বিচ্ছিন্ন ও একক নয়–তাবৎ পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগাযোগ ও আদান-প্রদানের সম্বন্ধ। যে মানুষ ও মানুষের জীবন নিয়ে রাষ্ট্রের কারবার সে মানুষ ও তার জীবন চলিষ্ণু, পরিবর্তনশীল ও জঙ্গম। অথচ ধর্ম হচ্ছে তার বিপরীত। চোদ্দ শত বছর আগেও ধর্ম যা ছিল এখনো তাই আছে, চোদ্দ শত বছর পরেও তাই থাকবে। যে কোরান-হাদিসের নির্দেশ মতো রাষ্ট্রীয় আইন কানুন প্রণয়নের দাবি উঠেছে, মানুষের জীবনে সহস্র রদবদল ঘটলেও তার রদবদল ঘটানো মানুষের সাধ্যাতীত। অথচ আজকের মানুষ আর চোদ্দ শত বছর আগের মানুষ কখনো এক নয় এবং চোদ্দ শত বছর পরের মানুষও এ মানুষ থাকবে না। তাদের জীবনের প্রয়োজন ও চাহিদা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, রুচি ও মূল্যবোধ স্বতন্ত্র হতে বাধ্য। জীবনের সমস্যাও হবে ভিন্নতর।