ঢাকায় যে শোচনীয় ঘটনা ঘটে গেল শুধু নিন্দায় তার কোন প্রতিকার হবে না, যদি না সরকার আর ছাত্র সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে। ছাত্ররা এখন যে রাজনীতি করছে, এ রাজনীতি তাদের ছাড়তে হবে। কোনো রকম রাজনীতিকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙিনায় ঢুকতে দেওয়া উচিত নয়। গোড়াতেই আমি সে কথা বলেছি। সরকারকে ছাত্র-ছাত্র সকলের ব্যাপারেই হতে হবে নিরপেক্ষ। সরকার নিরপেক্ষ হলে অনেক অশান্তির মূল উৎপাটিত হবে। ছাত্রদের মধ্যেও একটা সরকারি দল খাড়া করা শুধু যে চরম অপরিণামদর্শিতা তা নয়, এ এক চরম নির্বুদ্ধিতাও। এর ফলে শাসন শৃখলার দিক থেকে ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। হঠাৎ বিভিন্ন দলে গণ্ডগোল কি সংঘর্ষ দেখা দিলে, ইচ্ছা থাকলেও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষরা যেমন, তেমনি প্রশাসকরাও এ অবস্থায় পুরোপুরি নিরপেক্ষ হতে পারবেন না। ফলে অবস্থার সার্বিক অবনতি অনিবার্য। তখন অধ্যক্ষরা হন নিন্দিত। প্রশাসকরা হারান আস্থা।
অথচ সূত্র টানা হচ্ছে বহু দূর থেকে, যা অধ্যক্ষ কিংবা প্রশাসকদের নাগালের বাইরে। নিমিত্তের ভাগী করে এভাবে তাঁদের প্রতি করা হয় অবিচার। আমাদের প্রশাসন ব্যবস্থা আজ এ এক অদ্ভুত অবস্থার সম্মুখীন।
ঢাকার যে-শোচনীয় ঘটনার ইঙ্গিত আমি ওপরে করেছি, অনেক জায়গায় তার নাকি অশুভ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। চট্টগ্রামও নাকি বাদ যায় নি, এখানেও নাকি অনেক নিরীহ ছাত্র আক্রান্ত আর প্রহৃত হয়েছে। সংবাদপত্রকে দেওয়া হয়েছে হুমকি। প্রশাসন যন্ত্র নাকি এসব দমনের জন্য আশানুরূপ সক্রিয় হয়ে ওঠে নি। সত্য হলে এসব খুবই দুঃখের আর লজ্জার কথা। দলমত-নির্বিশেষে সব ছাত্র যাতে নিরাপদ বোধ করে আর নির্বিঘ্নে লেখাপড়া করে যেতে পারে তার পরিবেশ রক্ষা আর সৃষ্টির দায়িত্ব প্রশাসকদের। আমার বিশ্বাস জেলায় জেলায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যাঁদের ওপর ন্যস্ত তারা সবাই উচ্চশিক্ষিত। আমাদের মতো তাঁরাও দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতিকে ভালোবাসেন। কাজেই এ সব বিঘ্নিত হোক এ তারা চান–এ কথা ভাবা যায় না। চাকুরির বাইরে তাদেরও একটা ব্যক্তিসত্তা আছে। সেখানে সত্য, ন্যায় আর বিবেকের আহ্বানে তারাও সাড়া দেন। এ দুয়ের সমন্বয় হলেই গভর্নমেন্ট সার্ভান্ট সহজে পাবলিক সার্ভ্যান্ট তথা জনসেবক হয়ে ওঠেন। বলা বাহুল্য, শেষোক্ত পরিচয়ই অধিকতর গৌরবের। আমরাও আমাদের প্রশাসকদের কাছে এটুকুই আশা করছি। আর ছাত্রদের কাছে আশা করছি, প্রথম অনুচ্ছেদে আমি আমার যে-পঞ্চ নির্দেশের উল্লেখ করেছি তার প্রথমটি অন্তত তারা যেন মেনে চলতে চেষ্টা করে। তাহলে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ ফিরে না এসে পারে না। রাজনীতি করতে হয় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়ে করো গে–তাতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। ছাত্র রাজনীতির যে ভয়াবহ পরিণতি এখন দেখতে পাচ্ছি তাতে আমি বিচলিত বোধ না করে থাকতে পারছি না।
[‘ছাত্র রাজনীতির ভয়াবহ পরিণতি’ প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭০-এ সমকালীন চিন্তা গ্রন্থে।]
ধর্ম ও রাষ্ট্র
ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা ও বাদানুবাদের অন্ত নেই। আর সমস্যাটা হালেরও নয়, বহু পুরোনো। একটাকে আর একটার ওপর নির্ভরশীল করে তুললে–ধর্ম বা রাষ্ট্র কোনো পক্ষের ফায়দা হয়েছে কিনা, হচ্ছে কিনা, হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু তা বিচার করতে হলে নিরপেক্ষ সত্যসন্ধিৎসা অত্যাবশ্যক। কিন্তু আমাদের দেশে ধর্ম বা রাষ্ট্র কোনো ব্যাপারেই নির্ভেজাল সত্যসন্ধিৎসা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র পরিচালকদের অসহিষ্ণুতার প্রকাশ্য মোকাবিলা এক রকম অসম্ভব বললেই চলে। তাই এ সম্বন্ধে সত্যসন্ধিৎসুর সচেতন বুদ্ধিজীবীরাও চুপ থাকতে বাধ্য। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় এ পরিবেশের জন্যই আমাদের দেশে শ’, রাসেল কী হাক্সলির মতো বুদ্ধিজীবীর আবির্ভাব কল্পনাই করা যায় না।
ধর্মের সঙ্গে এমন একটা বুদ্ধি-বিচারহীন অন্ধ আবেগ মিশে রয়েছে যে, তাকে উপেক্ষা করার সাহস কেউই সঞ্চয় করতে পারছে না। গণতন্ত্রকে যদি রাষ্ট্রীয় আদর্শ বলে মেনে নেওয়া হয় তাহলে জনসাধারণ যত স্থল ও বিচারবুদ্ধিহীন আর তাদের দাবি যতই যুক্তিহীন হোক না কেন রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে উচ্চাভিলাষীরা তাদের দাবি যে শুধু মেনে নেবে তা নয়, পদে পদেই দেবে ওইসব দাবিকে প্রশ্রয়। স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে এ প্রশ্রয়ের নজির অনেক বেশি খোলাসা। অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীর কোনো রকম রাষ্ট্রীয় উচ্চাভিলাষ হয়তো নেই, কিন্তু দেহটার মায়া তো আছে। তাই আত্মঘাতী জেনেও অন্ধ আবেগকে সমীহ না করে তাদেরও উপায় নেই। ফলে এ দুই শ্রেণী–রাষ্ট্রবিদ ও বুদ্ধিজীবীকে পদে পদেই গোঁজামিলের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। গোঁজামিল দিয়ে কোনো রকমে টিকে থাকা যায় বটে, কিন্তু বড় কিছু করা যায় না–না রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে, না সাহিত্য শিল্পের ক্ষেত্রে, না মননশীলতায়। ধর্ম যাকে বলে স্টেটিক, অচল-অনড় একটা অচলায়তনের নিগড়ে তা আবদ্ধ–ধর্মকে বলা হয় অলৌকিক অপৌরুষের খোদায়ী! অত্যন্ত অসন্দিন্ধ ভাষায় বলা হয়েছে হযরত মোহাম্মদ শেষ নবী, কোরানের পর আর কোনো ঐশী কেতাব নাজেল হবে না।