২. জেলা কিংবা এলাকা প্রীতিকে দিও না প্রশ্রয়।
৩. প্রশ্ন কঠিন হয়েছে কিংবা পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে ধর্মঘট করে বসো না। কারণ এসব ছাত্রজীবনের অচ্ছেদ্য অঙ্গ, এতে তোমাদের ক্ষতি হয় সব চেয়ে বেশি।
৪. নৈতিক কারণে ছাড়া শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ো না।
৫. কোন ব্যাপারেই করো না বাড়াবাড়ি। পরিমিতিবোধ আত্মমর্যাদার লক্ষণ। ছাত্র সমাজের প্রতি এ পাঁচটি অনুরোধ আমার রইল।
(দেশ ও দেশের ছাত্র সমাজ : সমাজ সাহিত্য : রাষ্ট্র, পৃ. ২৯৫)
এ অনুরোধগুলির প্রতি বিশেষ করে প্রথমটির প্রতি আবারও নতুন করে আমার কণ্ঠের সমস্ত জোর দিয়ে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক আর শিক্ষানুরাগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
দুই
এখন রাষ্ট্র সব ক্ষমতার মালিক আর সব ক্ষমতার উৎস। এ ক্ষমতা পরিচালিত হয়। প্রশাসকদের হাত দিয়ে। প্রশাসনকে যন্ত্র বলা হলেও তা কিন্তু যান্ত্রিক নয়, তার পেছনে রয়েছে মানুষ। তারাই চালান আর নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতা। এ মানুষ যদি ন্যায়নিষ্ঠ আর নিরপেক্ষ না হন, দলমত-নির্বিশেষে সকলের প্রতি তারা যদি সমদৃষ্টিসম্পন্ন আর সম দায়িত্বশীল না হন তাহলে অরাজকতা অবশ্যম্ভাবী। আর অরাজকতার শিকার কখনো এক পক্ষ হয় না। ইতিহাস তা বলে। ছোরাছুরির ধর্মই বুমেরাং হওয়া। অবাধ ক্ষমতা যাদের হাতে থাকে অনেক সময় এ সত্যটা তারা বুঝতে পারেন না, বুঝতে চান না। আজকের দিনই একমাত্র দিন নয়, তার পরও মাস আছে, বছর আছে, যুগ আছে; বুমেরাং হওয়ার অনন্ত অবসর কালের হাতে। ক্ষমতা জিনিসটা চিরকালই অন্ধ ও হ্রস্বদৃষ্টি–-পরিণতি বুঝতে চায় না আদৌ।
অন্ধ ক্ষমতা আজ ছাত্র রাজনীতির এক অংশকে নাকি প্রশ্রয় দিচ্ছে, প্রশ্রয় দিয়ে বেপরোয়া করে তুলেছে ওদের। এ প্রশ্রয়ের ফলে আজ ছাত্রদের হাতে দেখা দিয়েছে। ছোরাছুরি, লোহার ডাণ্ডা আর হকি স্টিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রবীণ অধ্যাপককে লাঠি-পেটা করা হয়েছে, বিভিন্ন হল আক্রান্ত। মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার আর নার্সরা পর্যন্ত আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পান নি। বিভিন্ন স্থানে বহু ছাত্র আহত হয়েছে। এ সব ব্যাপারে দেশের প্রশাসনযন্ত্র যথাযথভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে শোনা যায় নি। সরকার-সমর্থক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সম্মানিত বিভাগীয় অধ্যক্ষ একবার অত্যন্ত বেদনার সাথে আমাকে বলেছিলেন, ‘যেদিন ছাত্ররা ডক্টর মাহমুদের ওপর লাঠি তুলেছে সেদিনই আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির ভরাডুবি হয়েছে।’ তিনি এও বলেছিলেন, ‘জীবিকার খাতিরে আমি ওখানে আজ চাকরি করছি বটে কিন্তু আমার ছেলেমেয়েকে কখনো ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ভর্তি করাবো না।’ আমার বিশ্বাস, ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ অধ্যাপকের আজ এই মনোভাব। এ যেন তাদের জন্য দিনগত পাপক্ষয়।
অন্যায় বা পাপকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে প্রশ্রয় দিলে তা সহস্রফণা হয়ে দেখা দেয়। এ ফণার দংশনেই সেদিন অকালে এক তরুণ জীবনের অবসান হল। এ শোচনীয়তম ট্র্যাজিক ঘটনার কার্যকারণ আর তার অঙ্কুর কখন কীভাবে বপন করা হয়েছে, কর্তৃপক্ষ তা অনুধাবন করে দেখবেন কিনা জানি না। সমস্ত ঘটনা-পরম্পরা মানস-চক্ষে নিরীক্ষণ করে সূচনা থেকে এসবে পরোক্ষভাবে তাদের কোন দায়িত্ব আছে কিনা, থাকলে সে দায়িত্ব তারা পুরোপুরি পালন করেছেন কিনা, সরকার আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা বিবেচনা করে দেখলে ভবিষ্যতের জন্য ফল ভালই হতো। তাদের মনোভাব আর দৃষ্টিভঙ্গিতে যদি ভুল ধরা পড়ে, আমাদের শিক্ষাজীবন আর সভ্যতার খাতিরে তা সংশোধিত হওয়া উচিত। সংশোধনে কিংবা ভুল স্বীকারে কিছুমাত্র লজ্জা নেই। বিশেষত, যেখানে গোটা সমাজ আর জাতির স্বার্থ বিপন্ন। এ দল আর ও দল জাতি নয়, সব দল মিলেই জাতি। সে জাতির স্বার্থ রক্ষা করতে হবে নির্ভীক আর নিরপেক্ষ হাতে। নিরপেক্ষতাই সবচেয়ে বড় কথা। সব মূল্যের বিনিময়ে হলেও এ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হয়। সরকার বা প্রশাসকরা কোন দলের নয়। দলের হতে গেলেই দেশের সর্বনাশ। এখন সে সর্বনাশের আলামত ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যাচ্ছে বলেই আমাদের আশঙ্কা।
নির্বাচনের আগে মানুষ দুলের থাকে–পরে শাসনকর্তত্ব যারা লাভ করেন তারা আর দলের থাকেন না, থাকা উচিত নয়। তারা তখন সমস্ত দেশের, সমস্ত নাগরিকের প্রতিভূ। বলা বাহুল্য, নির্বাচনে পরাজিত দলের স্বার্থেরও তারা তখন জামিন। শাসকরা যদি দলীয় হয়ে পড়েন, সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করেন, তাহলে তাদের হাতে শাসন। আর শাসন থাকে না–নির্যাতন আর শোষণ হয়ে দাঁড়ায়। ছাত্র রাজনীতির বেলায় প্রাদেশিক শাসন-যন্ত্র নিরপেক্ষ নন বরং দলীয় পক্ষপাতিত্বের পরিচয় দিচ্ছেন বলে এমন একটা গুজব যেখানে সেখানে এখন শোনা যায়; এ গুজব সত্য হলে এ যে বুমেরাং-এর পথ রচনা তাতে সন্দেহ নেই। এখন ছাত্র রাজনীতি যে-শোচনীয় দশায় পৌঁছেছে তাতে সরকারি দায়িত্ব কতখানি তা সরকার পরিচালকদের ভেবে দেখা উচিত।
তাঁরা যদি সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ না হন তাহলে আমাদের শিক্ষা আর সাংস্কৃতিক জীবন দ্রুতযানে না চড়েও দ্রুত রসাতলে যাবে।
তিন
সরকারের ক্ষমতার উৎস যেখানেই থাকুক, যেখান থেকেই পরিচালিত হোক– সরজমিনে যারা আছেন তারাই সরকারি ক্ষমতাকে প্রয়োগ করে থাকেন, করে থাকেন বাস্তবায়িত। বিশেষত, যারা প্রশাসনিক বিভাগে রয়েছেন আর যারা জেলায় জেলায় শাসন-শৃঙ্খলাকে বজায় রাখেন তাদের ওপর দেশের মঙ্গলামঙ্গল অনেকখানিই নির্ভর করে। তারা যদি দায়িত্বশীল আর নিরপেক্ষ হন তাহলে শাসন-শৃঙ্খলা সহজে ভেঙে পড়তে পারে না। তখন মানুষ নিরাপদ মনে করে নিজেকে। তেমন অবস্থায় সরকার যে-দলেরই হোক, শাসন ব্যবস্থার প্রতি মানুষ একটা আনুগত্য বোধ না করে পারে না। তারা দলীয় বা দলীয় মনোভাবের হয়ে পড়লেই দেশের জন্য বিপদ, তখনই দেখা দেয় আনুগত্যহীনতা। এভাবে রোপিত হয় আরাজকতার বীজ। শাসকদের ওপর জনসাধারণের আস্থা না থাকলে কোনো শাসন-ব্যবস্থাই সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। গায়ের জোরে কতটুকুই বা চালানো যায়? চালাতে গেলে অনেক ঝুঁকি নিয়েই চালাতে হয়। ফলে একদিন ডুবতে হয় স্বখাত সলিলে।