এখন পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষ শিল্পীর মনের এত কাছাকাছি এসে পড়েছে যে, যে কোন সৎ শিল্পী আজ মানবতন্ত্রী না হয়েই পারে না। ফলে যুগ-সচেতনতা বা যুগ জিজ্ঞাসা তার পক্ষে আজ অপরিহার্য। এ না হলে এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি পরিবেশের সঙ্গে বিরোধ আর অবিরাম সংঘর্ষ–তার ফলে হতাশা ও অতৃপ্তি। যা অনেকের ক্ষেত্রে বিষণ্ণতায় পরিণত। যুদ্ধোত্তর য়ুরোপে তাই আত্ম-সমালোচনাই বড় হয়ে উঠেছে–যেহেতু চিন্তার ক্ষেত্রে আমরা য়ুরোপের অনুগামী আমাদের সাহিত্য-শিল্পেও তাই তার ছায়াপাত না ঘটে পারে না। আমাদের সচেতন শিল্পীদের রচনারও এ কারণে এক বড় বৈশিষ্ট্য আত্মসমালোচনা।
সাহিত্যে ও শিল্পে আত্মসমালোচনার এক বিশেষ মূল্য রয়েছে–বলা বাহুল্য, এটা য়ুরোপীয় রেনেসাঁরই দান। এর ফলে মানুষ সংকীর্ণতার হাত থেকে রেহাই পায়, মনের দিগন্ত যায় বেড়ে, নিজের মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়, আর মূল্যবোধ সম্বন্ধে হয়ে ওঠে অধিকতর সচেতন।
আধুনিক সাহিত্য রচনা করতে হলে চাই আধুনিক মন। মনে যদি আধুনিকতা সম্বন্ধে সুষ্ঠু কোন ধারণা না থাকে তা হলে আধুনিককালে রচিত হলেও তা আধুনিক সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করবে না। শুধু আঙ্গিকে আধুনিকতার কোন মানে হয় না–আঙ্গিক-নির্ভর রচনার আয়ু কোন সময় দীর্ঘ নয়। সুসজ্জিতা, সালঙ্কারা তরুণী সুন্দরীর মৃতদেহের প্রতি মানুষ এক নজরের বেশি ফিরে তাকায় না, কিন্তু কৃষ্ণবর্ণা জীবন্ত সাঁওতাল তরুণীর প্রতি বয়োবৃদ্ধও ফিরে ফিরে তাকায়! আঙ্গিক-নির্ভর রচনা এক শারের বেশি দুবার কে পড়ে দেখে!
পাঠকে পাঠকেও বেশ-কম আছে বই কি। সচিত্র সিনেমা পত্রিকার পাঠক-সংখ্যা যে অনেক বেশি তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু খাঁটি শিল্পী কি অমন পাঠক নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন? আর ঐ পাঠক-নির্ভর সাহিত্যের প্রসার হলেই কি কোন দেশের সাহিত্য শিল্পের প্রসার ও সমৃদ্ধি হয়েছে বলে ভাবা যায়? কোন মহৎ সাহিত্যের প্রধান অংশ কি রম্যরচনা বা সিনেমা সাহিত্য?
তার যুগে অস্কার ওয়াইল্ড কম আধুনিক ছিলেন না, আজকের দিনেও তিনি অনাধুনিক হয়ে যান নি। এ আঙ্গিক-নির্ভর আধুনিকতা সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্য :
আমি নাম করতে চাই না–এরই মধ্যে আমাদের কারো কারো কোনো কোনো রচনায় কৃত্রিম আধুনিকতার এ দুর্লক্ষণ কি দেখা দেয় নি?
আমাদের সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমি আশাবাদী। আমাদের নতুন যাত্রার এ সামান্য কাল পরিসরে অগ্রগতি যেটুকু হয়েছে এবং যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে তা নিরাশ হওয়ার মতো নয়। তবে আমি সব রকম হীনম্মন্যতার বিরোধী–অনুকরণ হীনম্মন্যতারই আর এক নাম। সৃজনী-প্রতিভা ব্যক্তিকেন্দ্রিক–ব্যক্তি-মন আধুনিক হলে অর্থাৎ আধুনিকতা সম্বন্ধে পুরোপুরি সচেতন হলেই সাহিত্যে আধুনিকতার আবির্ভাব অনায়াসে হবে। সে সাহিত্যে লেখক যেমন, পাঠকও তেমনি খুঁজে পাৰে, দেখতে পাবে নিজের চেহারা।
ধার করা জামা-কাপড়ের মতো ধার করা আধুনিকতাও অশোভন, বেমানান।
[১৩৭১]
[‘আধুনিক মন; আধুনিক সাহিত্য’ প্রথম প্রকাশিত হয় মাহেনও পত্রিকার মার্চ ১৯৬৫ সংখ্যায়। এটি পরে সংকলিত হয় সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ গ্রন্থে (১৯৮০)।]
ছাত্র রাজনীতির ভয়াবহ পরিণতি
এক
রাষ্ট্র থাকলে রাজনীতিও থাকবে এ বিষয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু ছাত্রজীবন শিক্ষানবিশির জীবন, ভবিষ্যৎ জীবনের প্রস্তুতি আর দেহ-মন ও চরিত্র গড়ে ওঠার কাল। রাজনীতি এসবের অন্তরায়। তাই ছাত্ররা কোন রকম প্রত্যক্ষ রাজীনতিতে অংশ নিক, এ আমি চাই না–এর বিরুদ্ধে বার বার আমি আওয়াজ তুলেছি। ছাত্র আর অছাত্র কেউই আমার কথায় কর্ণপাত করে নি। রাজনীতির আগে ছাত্র শব্দ যোগ করলেই রাজনীতির চরিত্র বদলে যায় না। আমাদের দেশে যে রাজনীতি, বিশেষ করে আজাদির পর গড়ে উঠেছে, মোড় নিয়েছে আর রূপ নিয়েছে ও নিচ্ছে তার অনিবার্য পরিণতি দলাদলি, হিংসা-বিদ্বেষ চরম অসহিষ্ণুতা, আর বিপক্ষের বা ভিন্ন দলের সম্মানুষকেও নিজের শুধু নয় দেশেরও শত্রু মনে করা। এসব কিশোর মনের জন্য, বেড়ে ওঠা চরিত্রের জন্য বিষের চেয়েও মারাত্মক। শিক্ষক আর একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এ বিষক্রিয়া আমি দেখেছি। তাই ছাত্র রাজীনতির আমি ঘোর-বিরোধী। তবে যে কোন ছাত্রদল যখন আমাকে কিছু বলার জন্য আহ্বান করে তখন আমি তাদের ডাকে সাগ্রহে এ কারণে সাড়া দিয়ে থাকি যে, ওখানে গিয়ে বৃহত্তর ছাত্রসমাজকে কিছু ভালো কথা বলার সুযোগ হয়তো আমি পাবো। আমি যে-মঞ্চ থেকেই কথা বলি না কেন কারো মুখপাত্র হয়ে কথা বলি নি আজ পর্যন্ত। সব সময় আমার নিজের বক্তব্যই আমি বলেছি। ছাত্রদের বহু অপ্রিয় কথা আমি ছাত্রদের সভায় দাঁড়িয়ে তাদের সামনে বলতেও দ্বিধা করি নি। আমার বক্তব্যে আর আমার ভাষায় আমার বিশ্বাস আমার মতামতই প্রকাশিত হয়েছে। যাদের আহ্বানে আমি সভায় গিয়েছি তাদের মতামত তাতে কখনো প্রতিফলিত হয় নি। তিন চার বছর আগে এক ছাত্রসভায় ছাত্রদের সামনে পাঁচটি ‘না’ নীতিমালা আমি তুলে ধরেছিলাম। ছাত্র আর অছাত্র উভয়ের সামনে সেগুলি আবারও এখানে উদ্ধৃত করছি :
১. তোমাদের স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় বাইরের রাজনীতিকে ঢুকতে দিও না।