পাকিস্তান আন্দোলন ও তার সাফল্য কী জানি কেন আমাদের প্রতিভাবান সাহিত্যিক শিল্পীদের মন-মানসে কোনো নতুন জোয়ার আনতে পারে নি, অন্তরের অন্তঃস্থলকে গভীরভাবে নাড়া দেয় নি কারো, খুলে যায় নি তাদের চোখের সামনে সাহিত্য-শিল্পের কোনো নতুন দিগন্তরেখা। স্বাধীনতার অরুণোদয়ে কারো মন-মানস হয় নি মুখর–নতুন আবেগে আরো উদাত্ত-কণ্ঠ হয়ে ওঠে নি উচ্ছ্বসিত। কবি-চিত্তের উল্লাস কতখানি উচ্ছ্বসিত ও কল-মুখর হতে পারে তার নিদর্শন নজরুলের ‘প্রলয়োল্লাস’।
আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বেশ কিছুটা সাদৃশ্য আছে। নৃতত্ত্ব ও ভৌগোলিক ঐতিহ্যের দিক থেকে ইংরেজ ও আইরিশে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। সব বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আমাদেরও তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ইংল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন না হলে আয়ারল্যান্ড চিরকাল সংখ্যালঘু হয়েই থাকতো–জাতি হতে পারতো না কখনো। সেই যুগেও ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্সে আয়ারল্যান্ডের প্রতিনিধি ছিল। কিন্তু নিরঙ্কুশ মেজরিটির কাছে সেই প্রতিনিধিত্বের কোনো কার্যকরী মূল্য ছিল না। গণতান্ত্রিক নিয়মানুসারে তাদের চিরকাল মেজরিটির মুখপেক্ষী হয়েই থাকতে হতো। আমাদেরও অবস্থা ছিল অবিকল তাই। পাকিস্তান না হলে আমাদেরও চিরকাল থাকতে হতো মেজরিটির মুখাপেক্ষী হয়েই। আর থাকতে হত। ভারতের বহু সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সম্প্রদায় হয়েই–জাতি হতে পারতাম না আমরা কখনো। হতে হলে নিজেদের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বহু জিনিস ত্যাগ করে বৃহত্তর ভারতীয় জীবন-ধারার সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে যেতে হতো। তাই স্বতন্ত্র জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আয়ারল্যান্ডকে যেমন বৃহত্তর ও সর্বগ্রাসী ইংল্যান্ডের অধীনতাপাশ ছিন্ন করে স্বাধীন হওয়ার আন্দোলন করতে হয়েছিল, তেমনি আমাদেরও বৃহত্তর ও সর্বগ্রাসী ভারতীয় প্রভুত্বের বাইরে স্বতন্ত্র জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পাকিস্তান আন্দোলন না করে উপায় ছিল না।
সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে আইরিশ আন্দোলনের ব্যর্থতা দেখে সেই আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা বিশ্ববিখ্যাত কবি W. B. Yeats দুঃখ করে লিখেছেন : Ireland’s great moments had passed, and she had filled no roomy vessels with strong sweet wine where we have filled our porcelain jars against the coming winter.’ ইয়েটস স্বয়ং জাত কবি ও জাত শিল্পী। তাই কাকতালীয় সাহিত্যের ফাঁকি তার চোখে ধরা পড়তে দেরি লাগে নি। এই ব্যর্থতার কারণও তিনি নির্দেশ করেছেন: Immediate victory, immediate utility, became everything…। এই মনোভাব কখনো সাহিত্য শিল্পের অনুকূল নয়। আমাদের দশাও কি আজ তাই নয়? আমাদেরও পাকিস্তান আন্দোলন ও তার সাফল্যের great moment হারিয়ে গেছে, সাহিত্যের সুধাভাণ্ডে তা থেকে আমরা কিছুই সঞ্চয় করতে পারি নি যা দুর্দিনে ও সঙ্কটে আমাদের মন-মানসের পাথেয় হতে পারে। স্বাধীনতার পর আমরাও কি নগদ লাভ ও সদ্য সুবিধা আদায়ে মেতে উঠি নি? জনসাধারণের মত সাহিত্যিক-শিল্পীদেরও এই কি একমাত্র মোক্ষ হয় নি? শিল্পীর জন্য Cause বড় কথা নয়, Cause-কে কেন্দ্র করে যে জীবন আবর্তিত হচ্ছে, সেই নগ্ন। জীবন ও তার সুখ-দুঃখই শিল্পীর উপজীব্য।…’Life is greater than the cause and artists are the servants not of any cause but of more naked life, and above all of that in its nobler forms, where joy and sorrow are one, artificers of the great moment…’ পাকিস্তান আন্দোলন সেই দুর্লভ Great moment অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের জীবনে নিয়ে এসেছিল, কিন্তু সস্তা নগদ লাভের প্রলোভনে দিশেহারা হয়ে আমরা সেই Moment-এর সদ্ব্যবহার করতে পারি নি।
আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা ও পরিবেশের যে আভাস এই প্রবন্ধে আমি দিতে চেয়েছি তাতে শিল্পীর পক্ষে আত্মস্থ হওয়ার সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় যে কোনো great moment হারিয়ে যাওয়ারই কথা। জীবিকার প্রাথমিক স্বাধীনতাটুকুও যদি না থাকে শিল্পী আত্মস্থ হবেন কী করে? কী করে হবেন। বেপরোয়া? সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে শিল্পী বায়রনের দৃষ্টান্ত টেনে আনার দরকার নেই–বাংলা সাহিত্যে সেই দৃষ্টান্তের কিছুমাত্র অভাব নেই। বলা বাহুল্য, জাতশিল্পী মাত্রই বেপরোয়া। মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল সবাই শিল্পীর এই recklessness তথা বেপরোয়া মনোভাবের অধিকারী ছিলেন। তার জন্য দুঃখ এঁরা পেয়েছেন–বিশেষ করে মধুসূদন ও নজরুল। কিন্তু বেপরোয়া জীবনের যে সূর্য-স্বেদ তা থেকেও তাঁরা বঞ্চিত হন নি। ব্যবহারিক জীবনে বেপরোয়া হওয়া হয়তো বড় কথা নয়– বড় কথা ভাবে, কল্পনায়, কল্প-বস্তু গ্রহণে ও নির্মাণে বেপরোয়া হওয়ার অধিকার সব বড় শিল্পীরই এই এক বড় গুণ ও এক বড় অধিকার। বেপরোয়া হওয়ার স্বাধীনতা ছিল বলেই তো মধুসূদনের পক্ষে অমন করে রাবণ চরিত্র আঁকা সম্ভব হয়েছে–যা চরিত্র হিসেবে রামকেও ছাড়িয়ে গেছে। আর সমগ্র রবীন্দ্র-সাহিত্যই তো এক জাগ্রতচিত্ত শিল্পীর বেপরোয়া বিবেকেরই নিদর্শন। আজকের দিনে বিসর্জন, চোখের বালি বা ঘরে বাইরে যে সেদিনে কতখানি দুঃসাহসিক ব্যাপার ছিল তা হয়তো অনেকেই অনুমান করতে পারবে না। উগ্র স্বাদেশিকতা, অন্ধ জাতীয়তা, ধর্মীয় গোঁড়ামি রবীন্দ্রনাথের বেপরোয়া কলমের খোঁচা থেকে কিছুই রেহাই পায় নি। মুসলমানের মনে স্বতন্ত্র অস্তিত্ববোধ জাগ্রত হওয়ার বহু আগেই, সেই স্বদেশীযুগের বোমা-পিস্তলের আদি পর্বে তিনি তার ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে সন্ত্রাসবাদ সম্বন্ধে শুধু নয়–‘বন্দেমাতরম’ সংগীতের যথার্থ সম্বন্ধেও প্রশ্ন তুলে অনেকের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। এই মহাকবি অসংখ্য কবিতা, গানে ও নাটকে যে বেপরোয়া মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। শরৎচন্দ্র ছাড়া শরশ্চন্দ্রের কালে বইয়ের নাম চরিত্রহীন রাখা কেউ কি কল্পনা। করতে পারতো? এক বিখ্যাত মাসিক তো শুধু এ-নামের জন্যই এই লেখা ছাপতে অস্বীকার করেছিল। অমন বেপরোয়া ছিলেন বলেই তো তার পক্ষে রাজলক্ষ্মীর মত। মেয়েকে, বাসার ঝি সাবিত্রীকে বাংলা সাহিত্যে এক অভাবিত মর্যাদাপূর্ণ স্থান দান সম্ভব হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রও কি কম বেপরোয়া ছিলেন? না হয় সেই যুগে ‘রোহিণী’ চরিত্র আঁকা সম্ভব হত কি? ভাবুন, কতখানি বেপরোয়া হতে পারলে ‘বিদ্রোহী’র মত কবিতা লেখা যায়? নজরুল ছাড়া ‘বারাঙ্গনা’ নিয়ে অমন জোরালো কবিতা আর কে লিখতে পারতো? এখন তো অমন কবিতা লিখতে পারার কথা ভাবাই যায় না। বেপরোয়া মনোভাবের উত্তরাধিকারী ছাড়া বড় সাহিত্য, মহৎ সাহিত্য রচিত হতে পারে কি না এ বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বলা বাহুল্য, অনুকূল পরিবেশই তেমন মনোভাবের জন্ম দিতে পারে।