গ্রন্থভুক্ত লেখাগুলির মুদ্রণ-কপি প্রস্তুত করা হয়েছে ইতোমধ্যে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত আবুল ফজলের প্রবন্ধ গ্রন্থ থেকে। সেগুলি হচ্ছে: সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা (১৯৬১), সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন (১৯৬৫), সমাজ সাহিত্য রাষ্ট্র (১৯৬৮), সমকালীন চিন্তা (১৯৭০), মানবতন্ত্র (১৯৭২), শুভবুদ্ধি (১৯৭৪), সাহিত্য ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (১৯৭৪), সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধাবলী (১৯৮০) ও নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন (১৯৮১)। সম্পাদনার ক্ষেত্রে মূল রচনাকে অপরিবর্তিত রেখে কেবল বানানের সমতাবিধানকেই আমরা সংগত বিবেচনা করেছি। বানান পরিমার্জনার ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানের নিয়মকেই যথাসম্ভব অনুসরণ করা হয়েছে।
এ গ্রন্থ সংকলন ও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন আমার জন্যে গৌরবের ও আনন্দের। এ কাজে আমাকে আবুল ফজলের পরিবারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করেছেন বিশিষ্ট কবি, সাংবাদিক ও জনপ্রিয় কলাম লেখক বন্ধুপ্রতিম আবুল মোমেন। সম্পাদনার কাজেও প্রয়োজনীয় অকুণ্ঠ সহয়োগিতা করেছেন তিনি। এ গ্রন্থের গ্রুফ সংশোধন ও সম্পাদনায় সহায়তা করেছেন সাপ্তাহিক অনুবীক্ষণের ফিচার সম্পাদক মাসহুদা ইয়াসমিন। সময় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী জনাব ফরিদ আহমদের আন্তরিক আগ্রহে এ বই প্রকাশিত হল। এদের সকলকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাই।
মাহবুবুল হক
বাংলা বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১৭ সেপ্টেম্বর ২০০০
আধুনিক মন : আধুনিক সাহিত্য
পুরোনো হলেও অনেক কথা বার বার স্মরণ করতে হয়। বিশেষত, সাহিত্য ও শিল্পের ব্যাপারে। মানুষের মতো সাহিত্য-শিল্পের ঐতিহ্যও পুরোনো। পরিবেশের বদলের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনেরও বদল ঘটে। বদল ঘটে বলেই মনের যে ফসল–যাকে আমরা মানুষের সৃজনী-প্রতিভার অবদান বলে অভিহিত করে থাকি তাতেও পরিবর্তন ঘটে–অন্তরঙ্গে যেমন বহিরঙ্গেও তেমনি। এ পালাবদলের চিহ্ন এঁকে এঁকেই সাহিত্য-শিল্পের অশেষ অভিযাত্রা।
মনের মতোই তা যেমন পুরোনো ও চিরন্তন তেমনি গতিশীল ও গ্রহণশীল। তাই গতিধর্মের স্বাভাবিক নিয়মে শত পরিবর্তন মেনে নিয়েও মনের মতোই সাহিত্য-শিল্পেও চিরন্তনতার উপস্থিতি অপরিহার্য। না হলে পুরোনো শিল্পকর্ম কবেই বাতিল হয়ে যেতো–এমন কি দূর অতীত যুগে পরিবেশিত নন্দন-তত্ত্বকেও তো আমরা পারছি না আজও অস্বীকার করতে। শিল্প সম্বন্ধে এরিস্টটলের মতামত তাই আজও পরম শ্রদ্ধেয়।
বাংলা সাহিত্যে ত্রিশের সাহিত্যান্দোলন নামে পরিচিত শিল্প-সচেতনতার একটা ঢেউ উঠেছিল, যার তরঙ্গাঘাত পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যে এসে পৌঁছেছে অনেক পরে–বিভাগোত্তর কালেই, সে আন্দোলন বা ঢেউয়ের মৌল ত্রুটি বা কৃত্রিমতা সম্বন্ধে সজাগ না হলে ওখানে তার যে শোচনীয় পরিণতি ঘটেছে আমরাও তার হাত থেকে রেহাই পাবো না। সাহিত্যের যে মৌল উৎস নিজের মন ও পরিবেশ–বা উভয়ের সংগতি সাধন, অতি উৎসাহ বা সাহিত্যে নবত্ব আনয়নের মোহে ওখানকার শিল্পীরা তা আমলেই আনেন নি সেদিন; ফলে তাদের অধিকাংশ রচনাই হয়ে পড়েছে কৃত্রিম’ আর ‘ভূঁইফোড়’। প্রতিভা আর প্রস্তুতি সত্ত্বেও এ কারণে তাঁদের কেউ সার্থক শিল্পীর মর্যাদায় পারেন নি পৌঁছতে। ঐ আন্দোলনের তিন পুরোধা–প্রেমেন্দ্র মিত্র আশ্রয় আর স্বস্তি খুঁজেছেন সিনেমায়, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত রামকৃষ্ণে আর বুদ্ধদেব বসু বোদলেয়ারে। বোদলেয়ারের। কাব্য-উৎস আর পরিবেশ বাঙালি সাহিত্যিকের জন্য ‘গ্রিক’ বললে খুব কম বলা হয়–‘কেতাবি আনন্দের’ বেশি তার কাছে আশা করা বাতুলতা। বৈদেশিক উৎসের ওপর নির্ভর করলে শিল্পীকে হতাশার শিকার হতেই হবে। বিশ বছর সংগ্রামের পর কবিতা বন্ধ করে দিয়ে বুদ্ধদেব বোদলেয়ারে আশ্রয় খুঁজেছেন। যেমন তাঁর বন্ধু প্রেমেন্দ্র মিত্র আশ্রয় নিয়েছেন দেশী সিনেমায় আর অচিন্ত্য সেনগুপ্ত রামকৃষ্ণে–এও এক রকম স্বদেশী ধর্মীয় ‘ছায়াছবি’ বই তো নয়। পার্থিব আর অপার্থিবের এমন জগাখিচুড়িই কি সাহিত্যে আধুনিকতার লক্ষ্য ও আদর্শ? সাহিত্যের ইতিহাসে বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়ার নজিরের। বেশি এসবের কোন মূল্য নেই। অথচ আমাদের কোন কোন সাহিত্য-কর্মীকে তাই যেন আজ পেয়ে বসেছে। আশ্চর্য, যে ঘোড়াটা পশ্চিমবঙ্গে মরে প্রায় ভূত হয়ে গেছে আমাদের এসব সাহিত্য-কর্মীরা প্রাণপণে তাকেই পিটিয়ে চলেছেন।
আমাদের সাহিত্য আজ এক অদ্ভুত সমস্যার সম্মুখীন–এ কৃত্রিমতার অকারণ মোহ ছাড়াতে না পারলে আমাদের সাহিত্যে যাকে স্বকীয়তা বা চরিত্র বলা হয় তার পরিচয় ফুটে উঠবে না।
যুগ-জিজ্ঞাসায় সব সাহিত্যই আধুনিক–কিন্তু এ আধুনিকতার পটভূমি সব সময়। শিল্পীর মন আর পরিবেশ। সাহিত্যের মূল প্রেরণা-উৎস মন বটে কিন্তু পরিবেশ-বিচ্ছিন্ন মন আশ্রয়চুত বলে সে মন যে শিল্প-বস্তুর প্রেরণাস্থল সে শিল্পেরও আশ্রয়-চুত বা কৃত্রিম না হয়ে উপায় নেই। আধুনিক যুগ তথা আধুনিক মন এক বিচিত্র আন্তৰ্বান্দ্বিক জটিলতার সম্মুখীন–তার সংঘর্ষে ক্ষতবিক্ষত। সমস্ত পৃথিবী আর গোটা মানবজাতিই আজ শিল্পীর সামনে–কিন্তু পায়ের তলার সীমিত মাটিটুকুর আশ্রয় না হলে এবং সে আশ্রয় শক্ত না হলে কিসের ওপর দাঁড়িয়ে শিল্পী আজ এ বিরাটের সঙ্গে মোকাবিলা করবে? শিল্পীর সামনে আধুনিক যুগের এ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জের সামনে হাওয়াই দুর্গ নিরাপদ আশ্রয় নয়–হাওয়াই হাতিয়ার দিয়েও জেতা যাবে না এ লড়াই। তাহলে পশ্চিমবঙ্গের উল্লিখিত শিল্পীদের মতো পার্থিব কি অপার্থিবের নির্ঝঞ্ঝাট পক্ষ পটে আত্ম-পলায়নই হবে আমাদের শিল্পীদেরও ভাগ্যলিপি।