দুই
আমাদের দেশ ধর্ম বা ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার সুযোগের কোনো অভাব আছে বলে মনে হয় না। মক্তব মাদ্রাসার কথা বাদ দিলেও নিউ স্কিম মাদ্রাসাগুলি রয়েছে, যেখানে ইংরেজি, বাংলা, অঙ্কের সাথে সাথে প্রচুর ধর্মশিক্ষারও ব্যবস্থা আছে। তবুও শোনা যায় সে সব মাদ্রাসায়ও এখন ছাত্র সংখ্যা দিন দিন কমে এসেছে। যে-কোনো ধরনের মাদ্রাসা আর সেকুলার হাই স্কুলের আর ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের সঙ্গে সেক্যুলার। ইন্টারমিডিয়েট কলেজের তুলনা করে দেখলে এ সত্যটাই প্রকট হয় যে, দেশে ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষার তেমন কোনো চাহিদা নেই। আমাদের প্রায় সব কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম তথা ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। তার জন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য সেকুলার বিভাগের সঙ্গে তুলনা করে দেখলেও দেখা যায়, ওই বিভাগে ছাত্রসংখ্যা অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে কম।
সম্প্রতি ছাত্র ভর্তির প্রবল চাহিদা আর চাপ এড়াতে না পেরে বাধ্য হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন বিভাগে সিটের সংখ্যা কিছু কিছু বাড়িয়েছে। এ সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তিতে যে পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে তা নিম্নরূপ:
বিষয় –সিটের সাবেক সংখ্যা –এখন বাড়িয়ে যা করা হয়েছে
ইংরেজি – ৭৫ –৯০
বাংলা – ১০০ –১২০
অর্থনীতি – ১৫০ –১৬০
ইতিহাস – ৭৫ –৮৫
সমাজবিজ্ঞান – ৭৫ –৯০
দর্শন – ৬০–৮০
রাষ্ট্রবিজ্ঞান – ১৫০ –১৮০
বাণিজ্য – ১৫০ –১৭০
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক – ২৫ –৪০
মনস্তত্ত্ব – ৪০ –৪৫
ইসলামের ইতিহাস আর সংস্কৃতি – ৪০ –৬০
আরবি – ১৫ –২০
ইসলামিক স্টাডিজ – ২৫ –৬০
এসব বিষয়ে সিটের মোট সংখ্যা ছিল আগে ৮১৫, এখন বেড়ে তা হয়েছে ১১৭০।
ইসলামের ইতিহাস আর সংস্কৃতিকে ঠিক ধর্ম-ভিত্তিক বিষয় বলা যায় না, বরং সার্বিক ইতিহাসের অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য শাখা এটি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বিষয়ের অধ্যাপক একজন হিন্দু। কাজেই আরবি আর ইসলামিক স্টাডিজকেই শুধু ধর্ম-ভিত্তিক বিদ্যা বলা চলে। এ দুই বিষয়ে সিটের সংখ্যাল্পতা কি প্রমাণ করে না যে, দেশে ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষার তেমন চাহিদা নেই? থাকলে এ দুই বিষয়ের এমন শোচনীয় দশা ঘটতো না। শোনা যায়, এসব সিটের জন্যও তেমন কোনো প্রতিযোগিতা হয় না। অন্যদিকে, ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়গুলিতে ভর্তির জন্য কী রকম প্রতিযোগিতা ঘটে, তা কারো অজানা নয়। স্থান আর প্রয়োজনীয় সংখ্যক অধ্যাপকের অভাবে প্রবল দাবি থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে সিট বাড়ানো সম্ভব হয় নি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে। বিজ্ঞান শুধু যে ধর্মনিরপেক্ষ তা নয়, বিজ্ঞানের বহু থিওরি আর মতবাদের সঙ্গেও ধর্মের রীতিমতো বিরোধ রয়েছে। তবুও ধর্ম বা ধর্মভিত্তিক শিক্ষার চেয়ে বিজ্ঞানশিক্ষার চাহিদা দেশে অনেক বেশি। প্রতিবছর বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে বহু ছাত্র যে স্রেফ সিটের অভাবে ভর্তির সুযোগ পায় না, এ এক সার্বজনীন সত্য। দেশের ক্ষেত্রে এই তো বাস্তব অবস্থা। এ অবস্থায় ধর্মভিত্তিক শিক্ষার ধুয়া তুলে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত আর পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়ার কোনো মানে হয় কি? আশ্চর্য, চোখের সামনে সারা মধ্যপ্রাচ্যের শোচনীয় আর করুণ দশা দেখেও আমাদের একশ্রেণীর রাজনৈতিক নেতাদের চোখ খোলে না। একবারও এঁরা তাকিয়ে দেখেন না। বাস্তবের কঠিন মাটির দিকে, যে মাটিতে তারা পা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথ যে একবার বলেছিলেন : ‘ধর্ম-মোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভাল,’ মনে হয় কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়। ধর্মান্ধতার চেয়ে বড় অন্ধতা আর নেই। চোখের অন্ধতা শুধুমাত্র দৃষ্টিশক্তিই হরণ করে, কিন্তু ধর্মান্ধতা হরণ করে বুদ্ধি-যুক্তি-বিচার-বিবেক আর সব রকম মূল্যবোধ।
আরবদের মাতৃভাষা আরবি-কোরান-হাদিস, ফেকা-উসুল-তফসির ইত্যাদি যা কিছুকে এক কথায় ইসলামি ধর্ম-বিদ্যা বলা হয় তা সবই আরবিতে। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই আরবেরা এসবের সঙ্গে পরিচিত (এ সবকে বাদ দিয়ে ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষা আর কাকে বলা হয় আমার জানা নেই। তবুও শ্রেষ্ঠ ধার্মিকের আদর্শ কি এ যুগের আরবরা? তা যদি হতো আমার বিশ্বাস তাদের অবস্থা কখনো এমন শোচনীয় হতো না। ক্ষুদ্র এক শক্তির হাতে তারা যে শুধু পদে পদে পরাজিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে তা নয় তাদের জীবনমানও এখন সর্বনিম্নস্তরে। এত নিম্নে যে, ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার দাবিদারেরাও দৈহিক আরোগ্যের জন্য যেমন তাদের কাছে যায় না তেমনি পাঠায় না নিজেদের ছেলেমেয়েকে মানসিক সম্পদ তথা জ্ঞান আহরণের জন্যও ওইসব দেশে। ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষার অভাবেই কি এ পরিণতি? মনে হয় না। বরং আধুনিক শিক্ষা আর সেই শিক্ষাজাত দৃষ্টিভঙ্গির অভাবেরই এ ফল। কোনো ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষাই এ অধঃপতিত অবস্থা থেকে ওদের উদ্ধার করতে পারবে না। উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র উপায় মনেপ্রাণে আধুনিক শিক্ষাকে গ্রহণ করে সর্বতোভাবে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান আর যন্ত্রবিদ্যাকে আয়ত্ব করা, পরমুখাপেক্ষিতা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা। এ করা হলে, আমার বিশ্বাস, দশ কোটি মানুষ পৃথিবীতে আবারও অসাধ্য সাধন করতে পারে। তাদের চোখের সামনে ক্ষুদ্র ইসরাইল তার এক জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। জ্ঞানী শত্রুর কাছ থেকেও সব নিয়ে থাকে। আরবদেরও তা নেওয়া উচিত। ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার কোনো অভাব আরব দেশে নেই, ছিলও না ইসলামের আবির্ভাবের কাল থেকে। জামে আজহার নাকি প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় আর ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষাই যে ওখানে দেওয়া হয় তাতে বোধ করি সন্দেহ নেই। তবুও সে-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তেমন কোনো কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পারেন না। আরবদের এখন একমাত্র অভাব ধর্মনিরপেক্ষ তথা সেকুলার শিক্ষার। আমাদের দেশেও ধর্ম বা ধর্মভিত্তিক শিক্ষার সুযোগের কিছুমাত্র অভাব নেই। অসংখ্য মক্তব-মাদ্রাসা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে, যাতে ধর্মীয় শিক্ষার দরাজ ব্যবস্থা রয়েছে। তদুপরি আমাদের প্রায় সব কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতম স্তর পর্যন্ত ধর্মভিত্তিক তথা সব রকম ধর্মীয় বিদ্যা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা আছে। যারা ধর্মভিত্তিক শিক্ষার দাবির সমর্থনে জান দেওয়া নেওয়ার হুমকি দিয়ে থাকেন, তাঁরাও কি এসব সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে থাকেন? করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সিট তথা ছাত্র পরিসংখ্যান এমন বিপরীত তথ্য পরিবেশন করতো না।