কোরান-হাদিসের বাইরে যে ইসলাম, সে ইসলাম সম্বন্ধে আমার ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। আমার ধারণা সত্য, ন্যায়, সামাজিক সুবিচার, ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সাম্য ইত্যাদি যে সব বড় বড় বুলি শোনা যায় এর কোনোটাই ইসলামের একচেটিয়া নয়। সব ধর্ম ও সব রাষ্ট্রেই এগুলি স্বীকৃত–এমন কি কাফিরি রাষ্ট্রেও ‘মিথ্যা’ শুধু নিন্দনীয় নয়, দণ্ডনীয়ও। খ্রিস্টানি মুলুক ইংল্যান্ড-আমেরিকা আজ ‘মাঙ্গলিক’ দেশে পরিণত, যেখানে ধনী-দরিদ্র কারো চিকিৎসার খরচ লাগে না। আর পাকিস্তানে ইসলামের সামাজিক ন্যায় বিচার এখনো রাষ্ট্রবিদদের উচ্চরোল বক্তৃতা আর কেতাব-কোরানেই সীমাবদ্ধ। চিকিৎসার মতো মানবীয় ব্যাপারেও পাকিস্তানে ধনী-দরিদ্রের সুযোগ-সুবিধার আসমান-জমিন পার্থক্য বোধ করি কারো নজর এড়ানোর কথা নয়। ইসলামি ভ্রাতৃত্ব, ইসলামি সুবিচার ইত্যাদি জীবন ও বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন বড় বড় বুলি না আউড়িয়ে যা কিছু সর্বমানবীয় সত্য তার দিকে আমাদের রাষ্ট্রের পদক্ষেপ হলে একই সঙ্গে রাষ্ট্র ও নাগরিক উভয়েরই মঙ্গল হতো। তা ছাড়া ছোট-বড় সব বুলিই ফাঁকা ও ফাঁকি হতে বাধ্য। কারণ তার সঙ্গে ব্যবহারিক জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। কথার বাইরে তার অস্তিত্ব অনুপস্থিত।
‘স্বর্গ-রাজ্য’, ‘ধর্ম-রাজ্য’, ‘রাম-রাজ্য’, ইত্যাদি বহু বুলিই শোনা গেছে। এ সবের কী অর্থ আমি প্রশ্ন করে এ যাবৎ কোন সদুত্তর পাই নি। যারা এ সব বুলি আওড়ান তাদের নিজেদেরও এ সব বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ও সঠিক ধারণা নেই। ঢাকায় একবার এক সেমিনারে জনৈক সুপণ্ডিত অধ্যক্ষ এক প্রবন্ধ পড়েছিলেন। প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে আশা প্রকাশ করেছিলেন—’অচিরে পাকিস্তান স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে।’ সভাশেষে তাকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম–ভাই, স্বর্গরাজ্য কাকে বলে? তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চেয়েই রইলেন আমার দিকে, কোনো উত্তরই দিতে পারলেন না। মোট কথা, স্বর্গরাজ্য সম্বন্ধে তার নিজেরই কোনো ধারণা নেই–না থাকারই কথা। স্বর্গরাজ্য আমি যেমন দেখি নি তিনিও দেখেন নি। একটা ‘পবিত্র আশা’ প্রকাশ করতে হবে তাই করা। আসলে ওই বুলি একটা আকাশকুসুম মাত্র। ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ কথাটাও যাঁরা বলেন তাদের মনেও ওই রাষ্ট্র সম্বন্ধে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা যে আছে তা নয়, তারাও ওই শব্দ দুটির আড়ালে আর এক রকম আকাশকুসুমেরই চাষ করে থাকেন। এর সঙ্গে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ জড়িত রয়েছে বলে আপাতত এর চাষ জমছে ভালো।
[‘ধর্ম ও রাষ্ট্র’ প্রথম প্রকাশিত হয় সমকাল পত্রিকার বৈশাখ ১৩৭০ সংখ্যায়। পরে এটি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন এবং মানবতন্ত্র গ্রন্থে স্থান পায়।]
ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাপ্রসঙ্গে
এক
ধর্ম কথাটার মধ্যে একটা অসম্ভব মোহ রয়েছে। ফলে যে কোনো কিছুর সঙ্গে ধর্মকে তথা ধর্ম শব্দটাকে যখন জুড়ে দেওয়া হয় তখন তা হয়ে পড়ে স্রেফ আবেগের বিষয়। কোনো রকম যুক্তি-বিবেচনা তাতে আর ঠাঁই পায় না। এমন কি বুদ্ধি বা যুক্তি দিয়ে বিচার করে দেখার সাহসটুকুও যেন মানুষ তখন হারিয়ে বসে। কেউ কেউ তা করাকে মনে করে রীতিমতো বড় রকমের এক গুনাহ! যারা আরো এক ডিগ্রি বেশি গোঁড়া, তারা মনে করে স্রেফ নাস্তিকতা। বলা বাহুল্য, তারাই গোঁড়া, যারা বিচার-বিমুখ আর পরিচালিত হয় অন্ধ আবেগে। সামাজিক জীবনে এসব মানুষ অত্যন্ত বিপজ্জনক, কারণ, স্বভাবে এরা হয়ে থাকে চরম অসহিষ্ণু। ধর্মে পরমতসহিষ্ণুতার সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও এরা ধর্মের নামেই অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে থাকে সবচেয়ে বেশি। পরমতসহিষ্ণুতা শুধু-যে সত্যিকারের ধর্ম-জীবনের লক্ষণ তা নয়, সভ্য-জীবনেরও এক প্রধান শর্ত, সমাজ-জীবনেরও বুনিয়াদ। এ ছাড়া সমাজ-জীবন দুদিনেই মগের মুল্লুক না হয়ে যায় না। আমাদের মতো অনুন্নত দেশে ধর্মের বুলি, ধর্মের ভেক আর বাহ্যিক ধার্মিকতার একটা জনপ্রিয় লোক-ভোলানো আবেদন রয়েছে। তাই মানুষ সহজে এ খপ্পরে না পড়ে পারে না, এ কারণে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের এ হয়ে পড়েছে এক মোক্ষম অস্ত্র। ফলে, ধর্ম এখন এদের হাতে সব রকম আধ্যাত্মিক আবেদন হারিয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতি তথা রাজনৈতিক হাতিয়ার।
সম্প্রতি আমাদের দেশে ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাসম্বন্ধে একচোট উত্তেজক আলোচনা হয়ে গেছে। এ আলোচনা ভবিষ্যতে আরো যে অধিকতর উত্তেজক হয়ে উঠবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, আমরা নাকি অতি বেশি ধর্মপ্রাণ জাতি। খাঁটি অর্থে আমরা কতখানি ধর্মপ্রাণ তা সঠিকভাবে বলার উপায় নেই, তবে ধর্মের নামে আমরা যে প্রাণ দিতে আর নিতে জানি তার দেদার নজির আমাদের ইতিহাসে রয়েছে। আজো সমাপ্তি ঘটে নি সে ইতিহাসের।
.
কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা যায় ধর্মের নামে এই যে আমরা প্রাণ দেওয়া-নেওয়া করেছি, সে। কার সঙ্গে? কোনো বিধর্মীর সঙ্গে কি? ইতিহাস বলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের সঙ্গেই। একদল মুসলমানের সঙ্গেই। ওপরে শিক্ষা নিয়ে যে-উত্তেজক আলোচনার কথা বলেছি তাতেও সীমিতভাবে প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঘটেছে এবং ঘটেছে নিজেদের মধ্যেই। যে ধর্মের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ভ্রাতৃত্ব-প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষীদের হাতে সে ধর্ম হয়ে পড়েছে এখন ভ্রাতৃহননের হাতিয়ার! আশ্চর্য, আমাদের তথাকথিত ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা কিন্তু একবারও ভেবে কিংবা বিচার করে দেখে না যে, এতে কার কতটুকু ফায়দা হয়েছে। নিজের ধর্মের, নিজের দেশের, নিজের সমাজের, এমন কি ব্যক্তিগত পর্যায়েও কোনো লাভ হয়েছে কি কারো? বলেছি, তথাকথিত ধর্মপ্রাণরা স্বভাবতই বিচার-বিমুখ হয়ে থাকে। এসব সে বিচারবিমুখীনতারই শোচনীয় পরিণতি। না হয় সেই খোলাফা-এ-রাশেদিনের আমল থেকে ধর্মের নামে যে ভ্রাত হনন শুরু হয়েছে ইতিহাসের বিচিত্র পর্বে যা খারেজি-শিয়া-সুন্নি-ওহাবি-কাদিয়ানি-ফরায়েজি-লা-মজহাবি ইত্যাদি নানা নামে চিহ্নিত হয়ে বর্তমানে আমাদের দেশে ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার বহছে এসে ঠেকেছে, তাতে একবিন্দু ফায়দাও আমি লক্ষ করি নি কোথাও। বরং লক্ষ করেছি এতে ইসলামের নাম হয়েছে কলঙ্কিত, মুসলমান হয়েছে দুর্বল, দ্বিধা-বিভক্ত আর খণ্ডিত; আর ধর্মের আসল উদ্দেশ্য হয়েছে পদে পদে ব্যর্থ।