অথচ তেমন দাবি উঠেছে বলে এ যাবৎ শুনি নি এবং তেমন আইন-কানুন রচিত হয়েছে বা রচনার উদ্যোগ চলছে বলেও জানা যায় নি। খাঁটি মুসলমান ছাড়া ইসলামি শাসন বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে কে? যে হাকিম নিজে নামাজ পড়ে না সে হাকিম নামাজ না পড়ার জন্য শান্তি দেবে অন্যকে–কথাটা এক বড় রকমের পরিহাস নয় কি? দাবি জানানো হচ্ছে কোরান-হাদিসের পরিপন্থী কোনো আইন করা চলবে না। এও তো এক নেতিবাচক কথা। যদি দাবি করা হতো পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র ও আইন-কানুন সব কিছু কোরান হাদিসের নির্দেশানুসারেই রচিত হবে বা রচিত হোক তা হলেই অধিকতর সঙ্গত হতো। আগেই বলেছি, আমাদের রাষ্ট্রবিদরা প্রায় সকলেই অল্পবিস্তর আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত। তাঁরা মনে মনে ভালো করেই জানেন, এ যুগে শাস্ত্রীয় নির্দেশানুসারে কোনো রাষ্ট্রের আইন ও শাসনবিধি রচিত হলে তার সঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনায় বাধা ও সংঘর্ষ অনিবার্য। তাই ফাঁকি ও গোঁজামিলের মুখোশ পরে জনসাধারণের তথাকথিত ধর্মীয় আবেগকে ঘুম পাড়িয়ে তারা সস্তায় কাজ হাসিল করতে চান। এ না হলে তাদের রাজনৈতিক জীবনই যে ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। তারা ভাল করেই জানেন নামাজি-কালামি হওয়ার চেয়ে মন্ত্রী হওয়ার মূল্য ঢের বেশি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজির চেয়ে বেনামাজি মন্ত্রীর দাপট যে কতখানি বেশি তা কারও অজানা বা অদেখা নয়। বলেছি আধুনিক রাষ্ট্রীয় নীতি ও ধারণার সঙ্গে ধর্মীয় বিধিবিধানের সংঘর্ষ অনিবার্য। এ সংঘর্ষের স্বরূপ আমরা হজের বেলায় দেখেছি, আরো বেশি যদি দেখতে চান তো সুদের বেলায়, সিনেমা ও নাচগানের বেলায়ও দেখতে পাবেন। এ সবই পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। সুদও তো আমাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির এক অপরিহার্য অঙ্গ। ব্যক্তিগতের সীমা ছাড়িয়ে নামাজ-রোজাকেও রাষ্ট্রীয় আইনের এক্তেয়ারে নিয়ে এলে তাও নতুন নতুন সংঘর্ষেরই সৃষ্টি করবে। আমাদের ছাত্রাবস্থায় একবার রমজান মাসে সলিমউল্লাহ মুসলিম হলের ডাইনিং হল বন্ধ করে দেওয়ার বিরুদ্ধে এক নাছোড়বান্দা ছাত্র আদালতে নালিশ করেছিল। যতদূর মনে পড়ে, বিচারে ছাত্রটিরই জয় হয়েছিল। আধুনিক কালে আইনের সাহায্যে জোর করে ধর্ম পালন করা যাবে কিনা এও এক রীতিমতো বিরাট প্রশ্ন। একদিকে বছর বছর ঘটা করে মানবাধিকার দিবস পালন করা অন্যদিকে নামাজ-রোজাকে রাষ্ট্রীয় আইনের সাহায্যে বাধ্যতামূলক করা হলে তাতে মতামত ও উপাসনার স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষিত হবে কিনা, বিশ্ব রাজনীতির পটভূমিতে সে প্রশ্নও উঠতে পারে।
আজ প্রায় সব সভ্য রাষ্ট্রই বিশ্ব জাতি সংস্থার (U. N. O) সদস্য আর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ সব আইন কোনো ধর্ম শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসরণ করে রচিত হয় নি–রচিত হয়েছে আধুনিক জীবনের চাহিদা ও প্রয়োজনানুসারে এবং এসবই আধুনিক রাষ্ট্রীয় আর্দশ ও ধারণার পরিপূরক। ইংল্যান্ডের রাজা বা রাণী খ্রিস্টান, অধিকাংশ নাগরিকও খ্রিস্টান–এ অজুহাতে হঠাৎ যদি সেখানে আইন করা হয় যে, সব ইংরেজকেই প্রতি রবিবার গির্জায় হাজির হতে হবে এবং মানতে হবে যিশুখ্রিস্ট ঈশ্বরের সন্তান তা হলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অধিকাংশ ইংরেজ শুধু যে বিদ্রোহ করবে তা নয়–আন্তর্জাতিক আদালতে এ আইনের বিরুদ্ধে নালিশও উঠতে পারে। সে আদালতের অধিকাংশ বিচারক খ্রিস্টান হলেও তাতে বাইবেলের নির্দেশ যে হালে পানি পাবে না। তাও সুনিশ্চিত। ভারতে হিন্দু ধর্মানুসারে পূজা-অর্চনা আর পাকিস্তানে নামাজ-রোজা আইনের সাহায্যে বাধ্যতামূলক করলেও একই অবস্থার বরং এর চেয়েও খারাপ অবস্থার সম্মুখীন হতে হবেই। আসল কথা, এ যুগে কোনো রাষ্ট্রই ধর্মভিত্তিক হতে পারে না, পারবে না। করতে গেলেই ধর্মকে ফাঁকি ও গোঁজামিলের আড়ালে মুখ ঢাকতে হবে। তাই আমার বিশ্বাস, ধর্ম ও তার ফাঁকি ও শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ নিয়ে আধুনিক কোনো রাষ্ট্রই হালে পানি পাবে না। দুষ্টান্ত আগেও দিয়েছি, আরো দিচ্ছি। সুদ, প্রাণীর ছবি, মদ, বেশ্যা–এ সবই কোরান-হাদিসে সুকঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মুসলিম বা ইসলামি রাষ্ট্র’ হয়েও পাকিস্তানে এ সব রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। রাষ্ট্রীয় অনুমতি ছাড়া নগ্ন বা অর্ধনগ্ন কোনো ছবিই আমদানি করা যায় না, তেমনি লাইসেন্স ছাড়া মদ আমদানি বা বিক্রিও অসম্ভব। বহু শহরে-বন্দরে যে সব বেশ্যা নিবাস রয়েছে তাও রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা স্বীকৃত–অনুমোদিত। বলা বাহুল্য, এ সবই আধুনিক রাষ্ট্রের অনুষঙ্গ। ধর্মের দোহাই বা নির্দেশ এগুলিকে কিছুতেই বাতিল করতে পারে না। পারলে রাষ্ট্রের নামের সঙ্গে ‘ইসলামি’ বিশেষণ যোগ করার আগে পাকিস্তানে কোরান-হাদিসের বরখেলাপকারী সব কিছুকে নিশ্চিহ্ন করা উচিত ছিল। তা করা কি সম্ভব? ( রাষ্ট্রীয় দফতর থেকে যে খতিয়ান বের হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানের মদের পরিমাণ বছর বছর বেড়েই চলেছে–সরকারি অনুমতি ছাড়া একি সম্ভব?) তা করতে হলে সমস্ত পৃথিবীটাকেই নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে–করতে হবে নতুন সমাজ বিন্যাস, বিশেষ করে বর্তমান অর্থনীতিকে বদলাতে হবে গোড়া থেকে আগা অবধি। বর্তমানে স্বাধীন দুনিয়ার কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে এ করার ক্ষমতা আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে পাকিস্তানের যে সে ক্ষমতা নেই সে সম্বন্ধে আমি সুনিশ্চিত।