আমার বিশ্বাস, মূল সূত্র ও আদর্শের সঙ্গে যদি শাসনতন্ত্রের সঙ্গতি থাকতো তা হলে তাকে বাস্তবায়নের বিধিবিধানও শাসনতন্ত্রে সন্নিবিষ্ট হতো এবং পাকিস্তানের সমস্ত ধনসম্পদকে নাগরিকদের মধ্যে সমভাবে ভাগ করে দেওয়ার জন্য যথোপযুক্ত আইন কানুনও এতদিনে রচিত হতো। অন্তত তার আলামত দেখা যেতো। ধন বণ্টনের পাঁচসালা। কি দশমালা পরিকল্পনার চেহারা আমরা নিশ্চয় দেখতে পেতাম। এতদিনে কোনো নির্বাচিত গ্রাম কি থানা বা জেলার অথবা কোনো প্রশাসনিক বিভাগে এ সমতা বিধানের অর্থাৎ আল্লাহর সম্পদকে সকল বান্দার মধ্যে সমভাবে ভাগ করে দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে যেতো! কিন্তু তার কোনো পরিচয় বা আভাস কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে কি? বরং দেখতে পাওয়া যাচ্ছে অতি অল্পসংখ্যক লোক, ঘটনাচক্রে যারা রাষ্ট্রের ওপরতলায় স্থান পেয়েছেন, তারা যে আইন বা রোজগারের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন অধিকাংশ নাগরিক তার শতাংশ থেকেও বঞ্চিত। এ অবস্থার রদ-বদলের কোনো পরিকল্পনাই যেখানে নেই, সেখানে সব ধনসম্পদের মালিক আল্লাহ্–এ কথা ঘোষণার কোনো মানে হয় কি? স্রেফ এ ঘোষণার দ্বারা আল্লাহ বা আল্লাহর বান্দা কারো ফায়দা হচ্ছে কিনা তাও জিজ্ঞাস্য। অবশ্য এটুকু ফাঁকা কথায় অনেকের ধর্মীয় আবেগ যে চরিতার্থ হয়েছে ও হচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই।
ধর্ম ও রাষ্ট্রের সম্পর্কে কিছুটা বিশদভাবে বুঝতে চেষ্টা করলে ধর্মকে কীভাবে ফাঁকি ও গোঁজামিলের হাতিয়ার করে তোলা হয়েছে তা আরো বেশি করে ধরা পড়বে। ইসলাম অশরীরী, খেয়ালি বা ভৌতিক কিছু নয়। ঈমান অর্থাৎ আল্লাহর একত্বে ও নবীর প্রেরিতত্বে বিশ্বাস ইসলামের সর্বপ্রধান শর্ত এবং একমাত্র এটিই অপ্রত্যক্ষ অর্থাৎ এটাকে চোখে দেখে সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের কোনো উপায় নেই। ফলে, ফাঁকি দেওয়াও সহজ। এমন ফাঁকিবাজ বা মুনাফেকদের কথা কোরানে একাধিক জায়গায় উল্লেখিত হয়েছে। আল্লাহ বিশ্বের তাবৎ সম্পত্তির মালিক–ঈমানের মতো এটাও একটা অপ্রত্যক্ষ বিশ্বাসের কথা। রাষ্ট্রীয় আইনের সাহায্যে এ বিশ্বাসকে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা না করলে এখানেও ফাঁকির ক্ষেত্র থেকে যায় প্রশস্ত। এ কথা ওপরে একবার উল্লেখ করা হয়েছে। ধনসম্পদকে আইন করে বণ্টন করা এমন অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু যেটা নিছক বিশ্বাসের ব্যাপার তাকে আইন বা রাষ্ট্রীয় বিধির আওতায় আনা কিছুতেই সম্ভব নয়। ব্যক্তিগত স্বীকৃতি ছাড়া এ বিষয়ে অন্য রকম সাক্ষী বা প্রমাণও অচল। অথচ ব্যক্তিগত স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির ওপর আইন বা দণ্ডবিধি নির্ভর করতে পারে না। অন্য সাক্ষী-প্রমাণ থাকলে চোরের অস্বীকৃতির ওপর নির্ভর করে তাকে চৌর্যাপরাধ থেকে অব্যাহতি কোনো দেশের আইনই দেবে না। কি ঈমান বা বিশ্বাসের বেলায় তেমন সাক্ষী-প্রমাণের সুযোগ কোথায়? আর তেমন অপরাধের স্তরবিভাগও করা যাবে কী করে? ধরুন, কোনো রাষ্ট্রে যদি এমন আইন করা হয়, যে পাঁচ-ওয়াক্ত নামাজ পড়বে না সে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে। সে জাতীয় পরিষদের সদস্য হতে পারবে না এবং পারবে না মন্ত্রী হতে। তাহলে অবস্থাটা কেমন দাঁড়াবে একবার ভেবে দেখা যেতে পারে। যে কোনো ইসলামি রাষ্ট্রে এমন আইন যে শুধু যুক্তিসঙ্গত তা নয়, অত্যন্ত বাঞ্ছনীয়ও। রাষ্ট্রের নাম ইসলামি দিয়ে বাহবা কুড়াবেন অথচ যে বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানের ওপর ইসলামের প্রতিষ্ঠা তাকে আইন ও রাষ্ট্র বিধানে আমল দেবেন না, একি এক মস্ত স্ববিরোধী ব্যাপার নয়? দিলেও বিপদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে কি? আল্লাহ রসুলে একদম বিশ্বাস করেন না এমন নাম মাত্র মুসলমান, মুসলমান সমাজেও কম নেই–আর তাঁরাও যে জাতীয় পরিষদ সদস্য ও মন্ত্রী হতে চাইবেন তাও অত্যন্ত স্বাভাবিক। আর তা হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য তারা যে শুধু নামাজ পড়বেন তা নয়, পাঁচ-ওয়াক্ত নামাজ তারা জমাতের সঙ্গেই পড়বেন এবং আমি জোর করে বলতে পারি পল্টন-ময়দানের জমাতে তারা বিনা অজুতেও শরিক হবেন। তারা যে বাড়ি থেকে অজু করে আসেন নি তা আপনি প্রমাণ করবেন কী করে? এ আইন প্রয়োগের জন্য আলাদা একটা আই বি ডিপার্টমেন্ট খুললেও সন্তোষজনক ফল পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
শুনেছি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অব্যবহিত পরে ওলেমাদের এক প্রতিনিধিদল কায়েদে আজমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নামাজকে সারা পাকিস্তানে অর্ডিনেন্সের সাহায্যে বাধ্যতামূলক করার দাবি জানিয়েছিলেন। পাকিস্তান যখন মুসলিম রাষ্ট্র তখন তাকে ইসলামি আদর্শে গড়ে তুলতে হলে ইসলামের প্রধান স্তম্ভ নামাজকে বাধ্যতামূলক করা উচিত–এটাই ছিল তাদের প্রধান যুক্তি। উত্তরে কায়েদে আজম নাকি বলেছিলেন, এ করতে গেলে এ নতুন রাষ্ট্রের সব উন্নয়ন ও গঠনমূলক কাজ বন্ধ করে দিয়ে রাষ্ট্রের সমস্ত শক্তি এ অর্ডিনেন্স প্রয়োগেই নিয়োগ করতে হবে আর শহরে-বন্দরে, গ্রামে মহল্লায় সর্বত্র খালি জেলখানাই তৈরি করতে হবে আর মোতায়েন করতে হবে পুলিশ। তার সহজ কাণ্ডজ্ঞানের দ্বারা কায়েদে আজম সেদিন এভাবে ওলেমাদের ধর্মীয় আবেগ নিবৃত্ত করেছিলেন। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতার অসাধারণ জনপ্রিয়তা ও তার অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিত্ব সেদিন তার সহায় হয়েছিল। যদি তর্কের খাতির আমরা মেনেও নেই যে, অর্ডিনেন্স বা আইনের সাহায্যে নামাজকে যদি বাধ্যতামূলক করা হয়, তা হলে পাকিস্তানের সব মুসলিম নাগরিকই নামাজ পড়তে শুরু করবেন–আল্লাহর ভয়ে না হলেও আইনের ভয়ে তো বটেই। তা হলেও সমস্যা অন্যদিক থেকে দেখা দেবে, অত লোকের নামাজের জায়গা কোথায়? নামাজের বয়সী অন্তত পাঁচ ছ কোটি লোকও যদি থাকেন আর তারা যদি নামাজ পড়তে চান তা হলে কতটা মসজিদ দরকার তা একবার ভেবে দেখুন। রাষ্ট্রের সমস্ত রাজস্ব এ খাতে ব্যয় করলেও তাতে কুলাবে কিনা বিবেচ্য। নামাজ অবশ্য ঘরেও পড়া যায় কিন্তু তা হলেও ঘরে ঘরে পুলিশ মোতায়েন কি সম্ভবপর? যে কোনো আইন মানা ও প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা তা তদারকের ব্যবস্থা না থাকলে দু দিনেই তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। চুরি-ডাকাতি, খুন-জখম ইত্যাদি অপরাধ সম্পর্কীয় আইন তদারক করার জন্য যদি পুলিশ, থানা, বিচার ও দণ্ডের ব্যবস্থা না থাকত তবে এসব অপরাধ কীভাবে বেড়ে যেত একবার কল্পনা করে দেখা যেতে পারে। এ সব অপরাধ সম্বন্ধে কোরান-হাদিসে নিষেধ আর হুঁশিয়ারির তো অন্ত নেই। তাতে কুলাচ্ছে না বলেই তো আইনের আশ্রয় গ্রহণ। নামাজের বেলায় কি তা হবে না?