এর বড় কারণ, এ সব প্রতিষ্ঠান আর নেতারা ইসলামের নাম ব্যবহার করেন বটে, কিন্তু তাঁদের আসল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা। আগেই বলেছি, রাজনীতি হচ্ছে স্বভাবে বিরোধধর্মী, তাই রাজনীতির ক্ষেত্রে আলেমে আলেমেও মিল হয় না। দুই মসজিদের ইমামে ইমামে, রাজনীতির প্রভাবমুক্ত দুই মাদ্রাসার মোদাররেসে মোদাররেসে অতি সহজে মিল হয়ে থাকে, কিন্তু দুই রাজনৈতিক দলের আলেমে আলেমে মিল হওয়া দূরের কথা, বরং একে অপরের বিরুদ্ধে কুফরির ফতোয়া দিতেও দ্বিধা করে না। ধর্মের ক্ষেত্রে বা ধর্মের নামে রাজনীতি করতে গেলে এ পরিণতি না হয়ে যায় না। রাজনীতির বিরোধধর্মী স্বভাব এভাবে ধর্মীয় নেতাদেরও গ্রাস করে নেয়।
দুধের সঙ্গে পানি বা পানির সঙ্গে দুধ মেশালে যেমন একটা জলো বস্তুই তৈরি হয়, যাতে খাঁটি দুধ বা খাঁটি পানির কোনো স্বাদই থাকে না; তেমনি ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি বা রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম মেশালে সে একই পরিণতি না ঘটে পারে না। তখন ধর্মও যেমন ‘জলো’ হয়ে পড়বে, তেমনি ‘জলো’ হয়ে পড়বে রাজনীতিও। ফলে ধর্ম ও রাজনীতির যে আসল উদ্দেশ্য তা হয়ে যাবে ব্যর্থ। রাজনীতির সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক অচ্ছেদ্য বলে এ রকম অবস্থায় সর্বাগ্রে ধর্মই হয় ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষমতার জোরে বা মোহে তখন রাজনীতিই হয়ে পড়বে সর্বেসর্বা। যেমন খ্রিস্টীয় জগতে হয়েছে। ওখানেও ধর্মের প্রতিভূ চার্চ আর রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বে রাষ্ট্রই হয়েছে জয়ী। কারণ, ক্ষমতার মালিক আর নিয়ন্তা হচ্ছে রাষ্ট্র আর পরিচালনা করে রাজনীতিবিদরা। এ ব্যাপারে আমাদের দেশেও ভিন্নতর পরিণতি হওয়ার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করতে গেলে ধর্মকে আপস করতেই হবে পদে পদে। নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা যায় : আমাদের দেশে এখন যে আইন চালু রয়েছে তা যে কোরান আর সুন্নাহ মোতাবেক রচিত নয় তা সবারই জানা। আর এও অজানা নয় যে, ইসলামে সুদ দেওয়া-নেওয়া শুধু নয়, সুদের হিসেবপত্র লেখাও হারাম। এতদসত্ত্বেও দেখা যায়, আমাদের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির অনেক সদস্য এ আইনের সাহায্যে ব্যবসা করে জীবিকা অর্জন করে থাকেন। অনেকে চাকরি করেন বিভিন্ন ব্যাঙ্কে, যেখানে অহরহ চলছে সুদের লেন-দেন, তবু এসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের এসব সদস্যের পদত্যাগের বা ওইসব পেশা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বলে শোনা যায় নি এ যাবত। দিলেও এমন নির্দেশ কেউ মানবে বলেও মনে হয় না। এ সত্য আমার চেয়েও ওইসব প্রতিষ্ঠানের ‘আমির’ আর ‘নাজিম’রা আরো বেশি করে জানেন। তার চেয়েও তারা বেশি জানেন ওইসব লোক দলত্যাগ করলে বা ওদের বহিষ্কার করা হলে গোটা প্রতিষ্ঠানই হয়ে পড়বে দুর্বল। দুর্বল হয়ে পড়বে রাজনৈতিক অর্থেই। না হয় শরিয়ত বরখেলাপকারীদের বাদ দিয়ে একদম খাঁটি শরিয়তপন্থীদের নিয়ে যদি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয় তাহলে ধর্মের দিক দিয়ে এই প্রতিষ্ঠান খুবই মজবুত হওয়ার কথা। কিন্তু এরা তা করবেন না, কারণ ইসলামের নাম ব্যবহার করলেও খাঁটি ইসলামকে এঁরা যতখানি চান তার চেয়ে অনেক বেশি চান রাজনৈতিক ক্ষমতা। তাই শরিয়তের বরখেলাপ কাজে যারা লিপ্ত তাদেরও নিজেদের প্রতিষ্ঠানের সদস্য করতে ও রাখতে এঁদের ধর্মীয় বিবেকে বাধে না। এভাবে ধর্ম রাজনীতির সঙ্গে আপোস করে চলেছে আর এ আপোস করা হচ্ছে রাজনীতির সপক্ষে আর ধর্মের প্রতিকূলে। তাই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি স্রেফ ভাওতা ছাড়া কিছু না। এ ভাওতার ফলে ধর্মই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। কারণ, এদের হাতে পড়ে দিন দিন ধর্ম হারাচ্ছে তার আসল স্বরূপ। তাই খাঁটি ধার্মিকদের, যারা সত্যি সত্যি ধর্মকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসেন তাদের সাবধান হওয়া উচিত। অন্যদিকে রাজনীতিও রীতিমতো ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। ধর্ম আর রাজনীতির ভূমিকা যে সম্পূর্ণ আলাদা, এ জ্ঞান। জনসাধারণের থাকার কথা নয়। ফলে অতি সহজে এরা ঘোলাটে জলের মাছ হয়ে পড়ে, তখন ভাওতাবাজরাই পেয়ে যায় শিকারের এক অপূর্ব সুযোগ। তাই খাঁটি ধার্মিকের মতো খাঁটি রাজনীতিবিদদেরও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সম্বন্ধে হুঁশিয়ার থাকা উচিত। এদের হাতে ধর্ম যেমন কিছুতেই নির্ভেজাল খাঁটি থাকবে না, তেমনি এঁদের খপ্পরে পড়ে রাজনীতিও সুষ্ঠু আর সুস্থভাবে, আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পথ ধরে পারবে না গড়ে উঠতে। দেশের রাজনীতি সব সময় থেকে যাবে ঘোলাটে। এ অবস্থায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আরো দীর্ঘকাল থেকে যাবে জনগণের নাগালের বাইরে। ধর্ম নিজে গণতান্ত্রিক নয় বলে ধর্মীয় মালমসলা দিয়ে কিছুতেই গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় সৌধ গড়া যেতে পারে না। এও স্মরণীয়, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পাকিস্তানের বাইরের মুসলমানের জন্যও এক বড় রকমের বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারে। মুসলমান শুধু পাকিস্তানে বাস করে না, পৃথিবীর বহু দেশেই মুসলমান ছড়িয়ে আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মুসলমানরা সংখ্যালঘু। ভারতের পঞ্চাশ কোটি লোকের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা নাকি প্রায় পাঁচ কোটির মতো। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র যদি ভালো হয় তাহলে তা যে সব দেশ সব জাতির জন্যই ভালো তা না মেনে উপায় নেই। আমাদের তেমন ‘ভালো’ নজিরটা যদি ভারতও গ্রহণ করে অর্থাৎ তারাও যদি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তাহলে ওখানকার মুসলমানের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? স্বভাবতই ওরাও আমাদের মতো লোকসংখ্যার সংখ্যাপ্রধান অংশের ধর্মের ভিত্তিতেই তাদের রাষ্ট্রকে গড়ে তুলতে চাইবে। আমাদের ধর্ম আর সংস্কৃতি যেমন তৌহিদভিত্তিক, ওদের ধর্ম ও সংস্কৃতি তেমন প্রতিমাভিত্তিক। এ উভয় ধারণার মধ্যে শুধু যে ব্যবধান রয়েছে তা নয়, বরং রয়েছে প্রচণ্ডতম বিরোধ। শিক্ষিত হিন্দু সমাজের আচার-বিচার আর বিশ্বাস এখন যাই হোক না কেন, হিন্দু ধর্ম আর সংস্কৃতির সাথে প্রতিমার যে একটা অচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে তা অস্বীকার করা যায় না। এ সবই ইসলামি ধর্ম-বিশ্বাসের পরিপন্থী। যে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রকে গড়ে তোলা হবে সে ধর্মের বিধি-বিধান, আচার-বিচার, ধ্যান-ধারণা ইত্যাদি নিঃসন্দেহে শিক্ষা-দীক্ষা আর সমাজ-জীবনেও প্রতিফলিত হবে। না হয়ে পারে না। ভারত আর পাকিস্তান নিকটতম প্রতিবেশী। এ অবস্থায় একের প্রভাব অন্যের ওপর পড়বে না, এ ভাবা যায়। বলা বাহুল্য, ধর্মীয় আবেগও কলেরা-বসন্তের চেয়ে কম ছোঁয়াচে নয়। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র যদি এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানেও একদল যে ওইরকম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উঠে পড়ে লাগবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তখন পঁয়তাল্লিশ কোটি মানুষের ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক প্লাবনে পাঁচ কোটির ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের যদি বিলুপ্তির সম্ভাবনা দেখা দেয় তখন মামুলি প্রতিবাদ করার মুখও তো থাকবে না আমাদের। এখানেও অনুরূপভাবে সংখ্যালঘুর সাংস্কৃতিক জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা যে দেখা দেবে না তা নয়। সর্বত্রই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তথা রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধানতম শিকার হবে সংখ্যালঘুরাই। দৈহিক অর্থে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন না হলেও ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব বিপন্ন না হয়ে পারে না। মুসলমানরা যত দেশে সংখ্যাপ্রধান সে তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক দেশে তারা সংখ্যালঘু। তাই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি মুসলমানেরই ক্ষতির কারণ হবে সবচেয়ে বেশি। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও বর্ণভিত্তিক রাজনীতিরই দোসর–এ রাজনীতি মানুষকে মেলায় না, বিভক্ত করে, মানুষকে বন্ধু করে না, বরং বন্ধুকে শত্রু বানায়। পাকিস্তানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি প্রশ্রয় পেলে তা বহু দেশের মুসলমানের জন্যও এক অকারণ বিপদ ডেকে আনবে।