বলেছি ইসলাম আর মুসলমান আলাদা। অন্তত রাজনীতি ক্ষেত্রে তাই। মুসলমানকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা যায় কিন্তু ইসলামকে যায় না। তাই রাজনৈতিক অর্থে ধর্মীয় শাসন কথাটা অর্থহীন। ইংল্যান্ডে ইসলামি শাসন নেই কিন্তু বহু মুসলমান আছে, আমেরিকায়ও তাই। ইন্দোনেশিয়ায় মুসলমানেরাই সংখ্যা-প্রধান কিন্তু ইসলামি শাসন নেই। এভাবে অসংখ্য দেশের নাম করা যায় যেখানে ইসলামি শাসন’ নেই, কিন্তু বহু সৎ ও ধার্মিক মুসলমান রয়েছে। রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে জাগতিক ব্যাপার, ধর্ম তা নয়। রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য রাষ্ট্রের অন্তর্গত সব মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি, সামাজিক অর্থনৈতিক আর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিধান। দেশের রাজনৈতিক দলগুলি এর জন্য রচনা করে বিভিন্ন পরিকল্পনা, কর্মসূচি, খসড়া ইত্যাদি। আর চেষ্টা করে সেসবকে বাস্তবায়িত করতে নিজেরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে। এর অনেক কিছুই ধর্মীয় বিধি-বিধানের বাইরে। যেসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল এসব বিষয়ে কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা অতীতে যেমন তেমনি বর্তমানেও দেশের সামনে পেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে, এখন সেসব দলই পাকিস্তানের রাজনীতির ক্ষেত্রে ইসলাম’ আর ইসলামি শাসনের ধুয়া তুলেছে। আমার মতে, ইসলামি শাসন যদি প্রবর্তন করতে হয় তা সর্বাগ্রে করা উচিত ইসলামের জন্মস্থান মক্কা-মদিনায়। আর সেখান থেকে যদি দাবিটা উত্থাপিত হয় তাহলে তা অতি সহজে প্রচারিত হয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়তে পারবে। কারণ, সেখানে বিনা দাওয়াতে, বিনা দলীয় খরচে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান প্রতি বছর হজ্বের সময় সমবেত হয়ে থাকে। ইসলামি শাসনের আন্দোলনটা যদি সেখানেই দানা বেঁধে ওঠে, তাহলে ইসলামের মতো ইসলামি শাসনের দাবিও সূর্যকিরণের মতো সেখানে থেকেই দিকে দিকে, দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ার একটা অপূর্ব সুযোগ লাভ করবে আর সেটাই হবে অধিকতর কার্যকরী। ইসলাম যেমন বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, তেমনি ‘ইসলামি শাসনও বিচ্ছিন্ন ব্যাপার হতে পারে না। অন্তত মুসলমানপ্রধান দেশগুলিতে একে সার্বিক করে তুলতে হলে এর সূচনা ইসলামের জন্মস্থান থেকে হওয়াই উচিত। কিন্তু আশ্চর্য, আমাদের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলি আজো তেমন কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে শুনি নি। আসলে এদেরও উদ্দেশ্য ইসলামি শাসন’ নয়, ইসলামের নাম করে কোনো রকমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা। কারণ, অন্তত দিলে দিলে তারাও জানেন, ইসলামি শাসন পাকিস্তানে এককভাবে কায়েম হতে পারে না। ইসলামের সূচনা যেখানে সেখান থেকে হওয়াই কি অধিকতর স্বাভাবিক নয়? তাহলে বিভিন্ন দেশের মুসলমানেরা, ইসলামি শাসন জনগণের জীবনে কতখানি সুফলপ্রসূ হয়েছে, তা সহজে দেখতে পেতো এবং নিজেদের দেশেও ‘ইসলামি শাসনে’র সপক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলতে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত বোধ করতো। পাকিস্তান বহু ধর্মাবলম্বীর দেশ। এখানে যথাযথভাবে ধর্মীয় শাসন চালাতে গেলে সঙ্কট অনিবার্য। এমন কি সে সঙ্কটের ফলে দেশের রাজনৈতিক নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হতে পারে। কায়েদে আজমের এ সত্য জানা ছিল, তাই গোড়াতেই তিনি জাতির উদ্দেশ্যে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন : ‘Now I think we should keep that in front of us as our ideal, and you will find that in course of time Hindus would cease to be Hindus and Muslims would cease to be Muslims, not in the religious sense, because that is the personal faith of each individual, but in the political sense as the citizens of the state.’ (পাকিস্তান সংবিধান সভায় কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উদ্বোধনী ভাষণ দ্রষ্টব্য।)
আমাদের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নেতাদের যদি ‘political sense’ বা রাজনৈতিক বোধ থাকতো তাহলে তারা কখনো ধর্মীয় শাসনের এ অসম্ভব দাবি তুলতেন না। ধমীয় শাসন আধুনিক রাষ্ট্রে সম্ভবপর হলে কায়েদে আজম নিজেই তার প্রতি স্বীকৃতি জানাতেন। তার চেয়ে বড় রাজনীতিবিদ আর তার চেয়ে বড় মুসলিম নেতা এদেশে আজও জন্মায় নি। মুসলমান এখন কবরে আর ইসলাম শুধু কেতাবে উক্তিটা কার সঠিক মনে পড়ছে না। খুব সম্ভব আল্লামা ইকবালের। যারই হোক মনে। হয় কথাটা সত্য। খাঁটি মুসলমানরা এখন সব পরলোকে, দেশে তথাকথিত ইসলামি শাসন না থাকা সত্ত্বেও তারা কোরআন-হাদিস মোতাবেক খাঁটি মুসলমানের মতো জীবন যাপন করে এখন শেষ বিচার দিনের অপেক্ষায় আছেন কবরে শায়িত থেকে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে ওইসব লোকদের নিয়ে, যাদের ইসলাম কেতাবেই আবদ্ধ, প্রতিদিনের জীবনের অঙ্গ নয়। এরা কেতাবি ইসলামকে মস্তিষ্ক দিয়ে গ্রহণ আর হৃদয়। দিয়ে উপলব্ধি না করে স্রেফ মুখের বুলি আর স্লোগানের বিষয় করে নিয়েছেন। এরা ইসলামকে ব্যবহার করেন তোতা পাখির মতো। এঁদের জানা উচিত, ইসলাম সব মুসলমানের জন্যই কিন্তু রাজনীতি স্রেফ রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক কর্মী আর রাজনীতি সচেতনদের জন্যই।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ধর্ম আর রাজনীতি কখনো এক সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশতে পারে না, জোর করে মেশাতে গেলে দুয়েরই ক্ষতি অনিবার্য। দুয়ের স্বভাবে রয়েছে দুস্তর ব্যবধান। ধর্ম মিলনমূলক, মিলনধর্মী। রাজনীতি বিরোধমূলক বা বিরোধধর্মী। ধর্ম মানুষকে এক জমাতে মিলতে বলে এবং মেলায়। রাজনীতি তার বিপরীত। ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে রাজনীতিতেও অস্থায়ী সমঝোতা বা যুক্তফ্রন্ট হয় বটে, কিন্তু সেটাকে কিছুতেই সত্যিকার অর্থে মিলন বা ভ্রাতৃত্ব বন্ধন বলা যায় না, যা ধর্মের ক্ষেত্রে সম্ভব। অধিকন্তু গণতান্ত্রিক রাজনীতি সম্পূর্ণ দলভিত্তিক, এ রাজনীতি মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত করে। বিভক্ত করাই এর স্বভাব। এমন কি কর্মসূচি আর লক্ষ্য এক হলেও রাজনীতির ক্ষেত্রে মিলন ঘটে না। এ কারণে দেখা যায়, আমাদের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যেও বিরোধের অন্ত নেই।