[‘ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধটি গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৭০-এ সমকালীন চিন্তা গ্রন্থে।]
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিপদ
আমি রাজনীতিবিদ নই, কোনো রকম রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষাও আমার নেই। এ কথা ইতোপূর্বেও আমি উল্লেখ করেছি। তবুও আমি যে রাজনীতি বা রাজনৈতিক কোনো কোনো সমস্যা-সম্বন্ধে আমার মতামত ব্যক্ত করে থাকি তার কারণ, আমি বিশ্বাস করি যখনই দেশের সামনে কিংবা ব্যাপক অর্থে মানুষের সামনে কোনো সমস্যা দেখা দেয়, সে সম্বন্ধে ভাবা, চিন্তা করা আর সে ভাব আর চিন্তাকে দেশ আর মানুষের সামনে তুলে ধরা লেখকের এক প্রধান দায়িত্ব। লেখক সমাজ-বিচ্ছিন্ন নন, সমাজ-বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেন না। তার চিন্তা আর ভাব জনগণ গ্রহণ করবে কি করবে না সে স্বতন্ত্র কথা–তা লেখকের বিবেচ্য নয়। লেখকের দায়িত্ব নিজের উপলব্ধ সত্যকে প্রকাশ করা। এ না। করা মানে নিজের দায়িত্বের প্রতি চোখ বুজে থাকা। আবার প্রচারক নন বলে নিজের মতামত কারো ওপর চেপে দিতেও তিনি অনিচ্ছুক। তার প্রকাশিত মতামত-সম্বন্ধে পাঠক একটুখানি ভেবে দেখুক এই তার সর্বোচ্চ কামনা। লেখকের একটা ভূমিকা সম্বন্ধে এই আমার ধারণা, এ ধারণার বশবর্তী হয়ে আমি দেশের সাম্প্রতিক ঘটনা আর রাজনীতি-সম্বন্ধেও লিখে থাকি। আগেও লিখেছি। এ প্রবন্ধে আলোচ্য বিষয় সম্বন্ধেও ইতোপূর্বে আমি যে একাধিকবার লিখি নি তা নয়। কিন্তু আমার বিশ্বাস, বিষয়টি যেভাবে দিন দিন জটিলতর হয়ে উঠেছে তাতে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা যে শুধু বিঘ্নিত হবে তা নয়; প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাতমুখিতাই পেয়ে যাবে প্রশ্রয়। দেশের অগ্রগতি হবে পদে পদে ব্যাহত। তাই এসব আলোচনা পুনরাবৃত্তির দাবি রাখে। আমার বিশ্বাস, ধর্ম আর রাজনীতি সম্পূর্ণ আলাদা বস্তু। রাজনীতির প্রধান কাজ রাষ্ট্রপরিচালনা, রাষ্ট্রপরিচালনায় রাজনীতিকে পদে পদে আপোস করে চলতে হয়, কিন্তু ধর্ম তার সম্পূর্ণ বিপরীত, কোনো অবস্থানেই ধর্ম আপোস করতে রাজি নয়, আপোস করতে গেলেই ধর্ম তার খাঁটি রূপ বা অকৃত্রিমতা বজায় রাখতে পারবে না কিছুতেই। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যে কোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান চলে, কিন্তু ধর্মীয় কোনো ব্যাপারে এ পদ্ধতি অচল। গণ ভোটে ধর্মীয় বিষয়ের মীমাংসা করা হলে ধর্ম আর ধর্ম থাকবে না। আমরা আমাদের দেশের জন্য গণতন্ত্রকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছি (ধর্মীয় দলগুলিও এ চায়), কাজেই আমাদের রাজনীতির চেহারা আর চরিত্র হবে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক। গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম খাপ খায় না, শুধু গণতান্ত্রিক কেন, কোনো রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম খাপ খেতে পারে না। রাজনীতি, বিশেষ করে আধুনিক রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে সেকুলার, কিন্তু ধর্মকে আধুনিক বা অনাধুনিক নামে কিছুতেই চিহ্নিত করা যায় না। ধর্ম চিরন্তন–সে চিরন্তনের সঙ্গে দিনে দিনে পরিবর্তনশীল রাজনীতির নেকাহ্ দিতে গেলে সুখের দাম্পত্য-জীবন অকল্পনীয়। আমার আপত্তির প্রধান কারণ এখানে। এবার আমার বক্তব্য নিবেদন করছি।
ইদানিং ‘ইসলামি শাসন’ কথাটা আমাদের এক শ্রেণীর নেতা আর কর্মীর মুখে খুব একটা জনপ্রিয় তথা লোক-ভোলানো বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে লোক ভোলানো অতি সহজ এ কারণে যে, এর পেছনে একটা অন্ধ আবেগ রয়েছে, যে-আবেগ বুদ্ধিদীপ্ত কিংবা বাস্তব-ভিত্তিক নয় মোটেও। দেখা গেছে, ধর্মের নামে মানুষ কখনো যুক্তি বিচারের ধার ধারে না, স্রেফ একটা উত্তেজিত আবেগের স্রোতে যায় ভেসে। আমাদের দেশে যে সব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ধর্ম-ভিত্তিক শাসনের দাবি করা হচ্ছে, আদতে ধর্মের খেদমত বা ধর্ম প্রচার ওই সব প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা। সে ক্ষমতা দখল সহজ হবে মনে করেই এসব প্রতিষ্ঠান ধর্ম বা ইসলামকে করে নিয়েছে একমাত্র মূলধন। কারণ, এ মূলধনের সাহায্যে ধর্মপ্রাণ জনগণকে সহজেই উত্তেজিত করে তোলা যায়, যায় বিভ্রান্ত করা।
না হয় এসব প্রতিষ্ঠানের নেতারাও জানেন ‘ইসলাম’ বা অন্য যে কোনো ধর্ম রাজনীতির ঊর্ধ্বে, ধর্ম মোটেও রাজনীতির বিষয় হতে পারে না। বিশেষত ভূগোল ভিত্তিক যে রাজনীতি, ‘ইসলাম’কে তেমন রাজনীতিতে ব্যবহার করা হলে ইসলামকে খাটোই করা হয়। ধর্ম হিসেবে ইসলাম ভূগোল মানে না, পক্ষান্তরে, রাজনীতি শুধু যে ভূগোল মানে তা নয়, বরং ভৌগোলিক অবস্থান আর প্রয়োজন বোধে রাজনীতি অহরহ রূপ থেকে রূপান্তরে আবর্তিত হতে থাকে। এ কারণে মুসলমানপ্রধান দেশগুলিতেও রাজনীতি ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়েছে, নিতে বাধ্য হয়েছে। রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, গণতন্ত্র, এমন কি সমাজতন্ত্র ও মুসলমানপ্রধান দেশ ও অঞ্চলে বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে এ যুগেও। অধিকন্তু ইসলামকে রাজনীতির বিষয় করে তোলা হলে তাতে আঞ্চলিকতার প্রবেশ না ঘটে পারে না, অথচ ইসলাম কোনো অর্থেই আঞ্চলিক নয়। ধর্ম হিসেবে ইসলাম এক বিশ্ব-ধর্ম, বিশ্বের তাবত মানুষের ধর্ম। যার ইচ্ছা এ ধর্ম গ্রহণ করে, এ ধর্মের বিধিবিধান অনুসরণ করে জীবনযাপন করতে পারে। কিন্তু যে কোনো মুসলমান পাকিস্তানি বনতে পারে না রাতারাতি। রাজনৈতিক বহু আট-ঘাট পার হয়েই তবে তাকে হতে হয় পাকিস্তানি। কিন্তু মুসলমান হতে তার এক মিনিটও দেরি লাগে না। ধর্ম আর রাজনীতির ভূমিকা এত আলাদা যে, খাঁটি ধার্মিক আর খাঁটি রাজনীতিককে বুঝিয়ে বলার কোনো প্রয়োজনই নেই। ডালে-চালে মিশিয়ে খিচুড়ি হয়; কিন্তু ধর্ম আর রাজনীতি মিশিয়ে ধর্মীয় রাজনীতি হয় না। স্রেফ ভাওতা দেওয়া চলে শুধু ওই রাজনীতির নামে। আরো একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র। তবুও যে কোনো মুসলমান পাকিস্তানের নাগরিক হতে পারে না। এমন কি বিনা পাসপোর্টে পারে না প্রবেশ করতেও। তা করতে হলে আরো শর্ত পূরণ করা চাই। পাসপোর্টের অভাবে বহু মুসলমান ইসলামের জন্মস্থানে গিয়ে হজ্বের মতো ধর্মীয় কাজও যে করতে পারে না, তা বোধ করি কারো অজানা নয়। কাজেই এটা এক চক্ষুগ্রাহ্য সত্য যে, ইসলাম এক মুসলমান অন্য (বলা বাহুল্য, রাজনীতিতে অদৃশ্য দলীয় কারবারের কোনো স্থান নেই)। দেশগত রাজনীতি মুসলমানের জন্য, ইসলামের জন্য তা হতেই পারে না, দেশগত রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে ইসলামকে নিয়ে আসা হলে তা কিছুতেই তার ধর্মীয় অকৃত্রিমতা বজায় রাখতে পারবে না। পাসপোর্ট-ভিসা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ব্যাপার, ভূগোল-ভিত্তিক আধুনিক রাজনীতিরই এ এক আবিষ্কার। খাঁটি ধর্মীয় বিধানের দিক থেকে দেখলে একে ইসলাম-বিরোধী না বলে উপায় নেই। কারণ ধর্মীয় বিধি-বিধানের যেমন, নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি ব্যাপারে ইসলামে সরকারি বা বেসরকারি নিয়ন্ত্রণের কোনো হুকুম নেই বলেই আমার বিশ্বাস। থাকলে তা আলেমদের জানা থাকার কথা। পাকিস্তান নামে ইসলামি রাষ্ট্র হলেও শাসিত হয় আধুনিক রাষ্ট্রনীতির সাহায্যে। তাই ধর্মীয় বিধিবিধানের কথা কিছুমাত্র আমলে না এনেই, অন্যান্য আধুনিক রাষ্ট্রের মতো পাকিস্তানও পাসপোর্ট-ভিসা প্রবর্তন করেছে, করেছে ইসলাম-ধর্মাবলম্বীর জন্যও।