বয়স্যের এই বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া রাজকুমার অপার আনন্দসাগরে মগ্ন হইলেন; এবং ব্যগ্র হইয়া বারংবার কহিতে লাগিলেন, বয়স্য! ত্বরায় আমায় কর্ণাটনগরে লইয়া চল। অনন্তর, উভয়ে সমুচিত পরিচ্ছদধারণ ও অস্ত্ৰবন্ধনপূর্বক অশ্বে আরোহণ করিলেন। কতিপয় দিবসের পরে, কর্ণাটনগরে উপস্থিত হইয়া, তাঁহারা রাজবাটীর নিকটে গিয়া দেখিলেন, এক বৃদ্ধ আপন ভবনদ্বারে উপবিষ্টা আছে। উভয়ে, অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইয়া, তাহার নিকটে গিয়া কহিলেন, মা! আমরা বাণিজ্যব্যবসায়ী বিদেশীয় লোক; দ্রব্যসামগ্ৰী সমগ্র পশ্চাৎ আসিতেছে; বাসার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত, আমরা অগ্রসর হইয়াছি; যদি কৃপা করিয়া স্থান দাও, তবে থাকিতে পাই। বৃদ্ধা, তাঁহাদের মনোহর রূপ দর্শনে ও মধুর আলাপ শ্রবণে প্ৰীত হইয়া, প্ৰসন্ন মনে কহিল, এ তোমাদের গৃহ, যতদিন ইচ্ছা, সচ্ছন্দে অবস্থিতি কর।
এইরূপে, উভয়ে সেই বর্ষীয়সীর সদনে আবাসগ্রহণ করিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে বৃদ্ধা, তাঁহাদের সন্নিধানে আগমন করিয়া, কথোপকথন আরম্ভ করিলে, সৰ্বাধিকারিপুত্র জিজ্ঞাসা করিলেন, মা! কয়জন তোমার পরিবার, আর কি প্রকারে বা সংসারযাত্ৰানিৰ্বাহ হয়। বৃদ্ধা কহিল, আমার পুত্র রাজসংসারে কর্ম করে, রাজার অতি প্ৰিয় পাত্র। আর, পদ্মাবতী নামে রাজার এক কন্যা আছেন, আমি তাঁহার ধাত্রী ছিলাম। এক্ষণে বৃদ্ধ হইয়াছি, গৃহে থাকি; রাজা অনুগ্ৰহ করিয়া অন্ন বস্ত্ৰ দেন। আর, রাজকন্যা আমায় ভালবাসেন; এজন্য, প্রতিদিন, এক একবার, তাঁহাকে দেখিতে যাই। এই কথা শুনিয়া, রাজপুত্ৰ কহিলেন, কল্য যখন রাজবাটীতে যাইবে, আমায় বলিবে; আমি তোমা দ্বারা রাজকন্যার নিকট কোনও সংবাদ পাঠাইব। বৃদ্ধা কহিল, যদি প্রয়োজন থাকে, বল, আজই আমি রাজকন্যাকে জানাইয়া আসি। রাজকুমার, এই কথা শুনিবা মাত্র, অতিমাত্র হৃষ্ট হইয়া কহিলেন, তুমি রাজকন্যাকে বলিবে, শুক্লপঞ্চমীতে, সরোবরতীরে, যে রাজকুমারকে দেখিয়াছিলে, সে, তোমার সঙ্কেত অনুসারে, উপস্থিত হইয়াছে।
এই বাক্য কর্ণগোচর হইবামাত্র, বৃদ্ধা যষ্টিগ্রহণপূর্বক রাজভবনে গমন করিল। সে কন্যান্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, রাজকন্যা একাকিনী নির্জনে উপবিষ্টা আছেন। বৃদ্ধা সম্মুখবর্তিনী হইবামাত্র, রাজকন্যা সমাদরপূর্বক বসিতে আসন দিলেন। সে উপবিষ্ট হইয়া কহিল, বৎসে। বাল্যকালে, অনেক যত্নে, তোমায় মানুষ করিয়াছি। এক্ষণে, ভগবানের অনুগ্ৰহে, তুমি তরুণাবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছ। আমার অন্তঃকরণের একান্ত অভিলাষ এই, অবিলম্বে উপযুক্ত পাত্রের হস্তগতা হও। এইরূপ আড়ম্বরপূর্বক ভূমিকা করিয়া, বৃদ্ধা কহিতে লাগিল, শুক্লপঞ্চমীতে, বাপীতটে, যে রাজকুমারের মন হরণ করিয়া আনিয়াছিলে, তিনি আমার গৃহে উপস্থিত হইয়াছেন, এবং আমা দ্বারা এই সংবাদ পঠাইয়াছেন, কমলসঙ্কেত দ্বারা যে অভিপ্ৰায় প্ৰকাশ করিয়াছিলে, তাহা সম্পন্ন কর; আমি উপস্থিত হইয়াছি। আর, আমিও কহিতেছি, এই রাজকুমার সর্বাংশে তোমার যোগ্য পাত্র; তুমি যেরূপ রূপবতী ও গুণবতী, তিনিও সর্বাংশে তদনুরূপ।
রাজকন্যা শ্রবণমাত্র, কোপ প্রকাশ করিয়া, হস্তে চন্দন লেপনপূর্বক, বৃদ্ধর উভয় গণ্ডে চপেটাঘাত করিলেন, এবং কহিলেন, তুমি এই মূহুর্তে আমার অন্তঃপুর হইতে দূর হও। বৃদ্ধা, এইপ্ৰকার তিরস্কার লাভ করিয়া, বিরক্ত হইয়া, বিষন্ন বদনে সদনে প্রত্যাগমনপূর্বক, পূর্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত রাজকুমারের কর্ণগোচর করিল। তিনি শ্রবণমাত্র, অতিমাত্র ব্যাকুল ও হতাশ্বাস হইয়া, দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্বক, পার্শ্ববর্তী প্রিয় বয়স্যের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া কহিতে লাগিলেন, সখে। এখন কি উপায় করি; নিতান্ত বুঝিলাম, বিধি বাম হইয়াছেন; মনস্কামসিদ্ধির কোনও সম্ভাবনা আছে, এরূপ বোধ হইতেছে না; নতুবা, সেই বামলোচনা, কি নিমিত্ত, তিরস্কার করিয়া, বৃদ্ধাকে বিদায় করিল। অন্তঃকরণে অনুরাগ সঞ্চার হইলে, দূতীর প্রতি এত অনাদর হয় না। তখন তিনি কহিলেন, বয়স্য! মৰ্মগ্রহ না করিয়া, অকারণে এত ব্যাকুল হও কেন। শ্ৰীখণ্ডরসে অভিষিক্ত দশ করশাখা দ্বারা প্ৰহারের তাৎপৰ্য এই যে, শুক্ল পক্ষের দশ দিবস অবশিষ্ট আছে; তদবসানে, অর্থাৎ কৃষ্ণ পক্ষে তোমার সহিত সমাগম হইবেক।
শুক্ল পক্ষ অতিক্রান্ত হইল। বৃদ্ধা, পুনরায় রাজকুমারীর নিকটে গিয়া, রাজকুমারের প্রার্থনা জানাইল। তিনি শুনিয়া সাতিশয় কোপপ্ৰকাশ করিলেন; এবং, গলহস্তপ্রদানপূর্বক, বৃদ্ধাকে, অন্তঃপুরের খড়কী দিয়া, বিদায় করিয়া দিলেন। সে, তৎক্ষণাৎ রাজকুমারের নিকটে গিয়া, এই বৃত্তান্ত জানাইল। তিনি শুনিয়া, নিতান্ত হতাশ্বাস হইয়া, দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্বক, অধোমুখে চিন্তা করিতে লাগিলেন। তখন সৰ্বাধিকারীর পুত্ৰ কহিলেন, বয়স্য! কেন উৎকণ্ঠিত হইতেছে, আর ভাবনা নাই; এ অনুকুল গলহস্ত, অপ্ৰশস্ত নহে; তুমি পূর্ণমনোরথ হইয়াছ। অন্য রজনীযোগে, তোমায়, সেই খড়কী দিয়া, তাহার অন্তঃপুরে যাইতে সঙ্কেত করিয়াছে। রাজপুত্র, আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইয়া, নিতান্ত উৎসুক চিত্তে, সূৰ্যদেবের অস্তগমনপ্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।
রজনী উপস্থিত হইল। রাজকুমার, বিহারযোগ্য বেশভূষার সমাধান করিয়া, প্রিয় বয়স্যের সহিত, অন্তঃপুরের খড়কীতে উপস্থিত হইলেন। সর্বাধিকারীর পুত্র বহির্ভাগে দণ্ডায়মান রহিলেন; তিনি, তন্মধ্যে দিয়া, অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন; দেখিলেন, রাজকুমারী তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছেন। নয়নে নয়নে আলিঙ্গন হওয়াতে, উভয়ে চরিতার্থতা প্রাপ্ত হইলেন। রাজকুমারী, পার্শ্ববর্তিনী বয়স্যার প্রতি, দ্বার বদ্ধ করিবার আদেশ দিয়া, রাজকুমারের করগ্রহণপূর্বক, বিলাসভবনে প্রবেশ করিলেন, এবং সুশোভিত স্বর্ণময় পল্যঙ্কে উপবেশনানন্তর, বল্লভের কণ্ঠদেশে স্বহস্তসঙ্কলিত ললিত মালতীমালা সমৰ্পণ করিয়া, স্বয়ং তালবৃন্তসঞ্চালন করিতে লাগিলেন। তখন রাজকুমার কহিলেন, প্রিয়ে! তোমার বদনসুধাকরসন্দর্শনেই, আমার চিত্তচকোর চরিতার্থ হইয়াছে, আর এরূপ ক্লেশস্বীকারের প্রয়োজন নাই; বিশেষতঃ, তোমার কোমল করপল্লব শিরীষ কুসুম অপেক্ষাও সুকুমার, কোনও ক্রমে তালবৃন্তধারণের যোগ্য নহে; আমার হস্তে দাও; আমি তোমার সেবা দ্বারা আত্মাকে চরিতার্থ করি। পদ্মাবতী কহিলেন, নাথ! আমার জন্য, তোমায় অনেক ক্লেশভোগ করিতে হইয়াছে; অতএব, তোমার সেবা করাই আমার উচিত হয়।