কৃষ্ণচতুর্দশী উপস্থিত হইল। সন্ন্যাসী, সায়ং সময়ে, আবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীর সংগ্ৰহপূর্বক, শ্মশানে যোগাসনে বসিলেন। রাজা বিক্ৰমাদিত্যও, প্রতিশ্রুত সময় সমুপস্থিত দেখিয়া, সাহসে নির্ভর করিয়া, করে তরবারি ধারণপূর্বক, একাকী সন্ন্যাসীর আশ্রমে উপস্থিত হইলেন; দেখিলেন, বহুসংখ্যক বিকটাকৃতি ভূত, প্ৰেত, পিশাচ, শঙ্খিনী, ডাকিনী প্রভৃতি আনন্দে উন্মত্তপ্রায় হইয়া, সন্ন্যাসীর চতুর্দ্দিকে নৃত্য করিতেছে; সন্ন্যাসী, যোগাসনে আসীন হইয়া, দুই হস্তে দুই নরকপাল লইয়া, বাদ্য করিতেছেন। রাজা, এতাদৃশ্য ভয়াবহ ব্যাপার দর্শনে, কিঞ্চিম্মাত্র ভীত হইলেন না; যথোপযুক্ত ভক্তিযোগ সহকারে প্রণাম করিয়া, কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন, মহাশয়! ভৃত্য উপস্থিত; আদেশ দ্বারা চরিতার্থ করিতে আজ্ঞা হয়। যোগী, আশীৰ্বাদপ্রয়োগপূর্বক, সমীপপাতিত আসনের দিকে অঙ্গুলি প্রয়োগ করিয়া কহিলেন, এই আসনে উপবেশন কর।
রাজা, তদীয় আদেশ অনুসারে, আসন পরিগ্রহ করিয়া, কিয়ৎক্ষণ পরে, পুনরায় নিবেদন করিলেন, মহাশয়! ভৃত্যের প্রতি কি আজ্ঞা হয়। যোগী কহিলেন, মহারাজ! তোমার বাক্যনিষ্ঠায় নিরতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি। বুঝিলাম, সৎপুরুষেরা, প্ৰাণান্তেও, প্ৰতিজ্ঞাপ্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হয়েন না। যাহা হউক, যদি অনুগ্ৰহ করিয়া আসিয়াছ, এক বিষয়ে আমার সাহায্য কর। দুই ক্রোশ দক্ষিণে এক শ্মশান আছে; তথায় দেখিতে পাইবে, এক শিরীষবৃক্ষে শব ঝুলিতেছে; ঐ শব আমার নিকটে লাইয়া আইস। রাজা, যে আজ্ঞা বলিয়া, তৎক্ষণাৎ প্ৰস্থান করিলেন। এইরূপে, রাজাকে শবানয়নে প্রেরণপূর্বক, যথাবিধি বিবিধ আয়োজন করিয়া, সন্ন্যাসী পূজায় বসিলেন।
একে কৃষ্ণচতুর্দশীর রাত্ৰি সহজেই ঘোরতর অন্ধকারে আবৃত; তাহাতে আবার, ঘনঘটা দ্বারা গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন হইয়া মুষলধারায় বৃষ্টি হইতেছিল; আর, ভূতপ্ৰেতগণ চতুর্দ্দিকে ভয়ানক কোলাহল করিতেছিল। এইরূপ সঙ্কটে কাহার হৃদয়ে না ভয়সঞ্চার হয়। কিন্তু রাজার তাহাতে ভয় বা ব্যাকুলতার লেশমাত্ৰ উপস্থিত হইল না। পরিশেষে, নানা সঙ্কট হইতে উত্তীর্ণ হইয়া, রাজা নির্দ্দিষ্ট প্ৰেতভূমিতে উপনীত হইলেন; দেখিলেন, কোনও স্থলে অতি বিকটমূর্তি ভূতপ্ৰেতগণ, জীবিত মনুষ্য ধরিয়া, তাহাদের মাংস ভক্ষণ করিতেছে; কোনও স্থলে ডাকিনীগণ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালক ধরিয়া, তদীয় অঙ্গপ্ৰত্যঙ্গ চর্বণ করিতেছে। রাজা, ইতস্ততঃ অনেক অন্বেষণ করিয়া, পরিশেষে শিরীষবৃক্ষের নিকটে গিয়া দেখিলেন, উহার মূল অবধি অগ্রভাগ পর্যন্ত, প্ৰত্যেক বিটপ ও পল্লব ধক্ ধক্ করিয়া জ্বলিতেছে; আর, চারিদিকে অনবরত কেবল মার্ মার্, কাট্ কাট্ ইত্যাদি ভয়ানক শব্দ হইতেছে।
এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়াও রাজা ভয় পাইলেন না; কিন্তু মনে মনে বিবেচনা করিয়া স্থির করিলেন, যক্ষ যে যোগীর কথা কহিয়াছিল, এ সেই ব্যক্তি, তাহার সন্দেহ নাই। অনন্তর, তিনি সেই বৃক্ষের সন্নিহিত হইয়া দেখিলেন, শব রজ্জুবদ্ধ, অধঃশিরাঃ, লম্বমান রহিয়াছে। শবদর্শনে শ্রম সফল বোধ করিয়া, রাজা সাতিশয় আহ্লাদিত হইলেন। এবং, নিৰ্ভয়ে বৃক্ষে আরোহণপূর্বক, খড়গাঘাত দ্বারা, শবের বন্ধনরজ্জ্ব ছিন্ন করিলেন। শব, ভূতলে পতিত হইবামাত্ৰ, উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিল। রাজা, তদীয় কণ্ঠরব শ্ৰবণে, সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন, এবং ত্বরায় তরু হইতে অবতীর্ণ হইয়া, নিকটে গিয়া জিজ্ঞাসিলেন, তুমি কে, কি নিমিত্তে তোমার এরূপ দুরবস্থা ঘাঁটিয়াছে, বল। শব খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল। রাজা, দেখিয়া শুনিয়া, সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন ও চিন্তান্বিত হইলেন, এবং এই অদ্ভুত ব্যাপারের মর্মাববোধে অসমৰ্থ হইয়া, অন্তঃকরণে অশেষপ্রকার কল্পনা করিতে লাগিলেন।
এই অবকাশে শব, বৃক্ষে উঠিয়া পূর্ববৎ রজ্জুবদ্ধ ও লম্বমান হইয়া রহিল। রাজাও তৎক্ষণাৎ বৃক্ষে আরোহণ ও রজ্জুচ্ছেদন পুরঃসর, শবকে কক্ষে নিক্ষিপ্ত করিয়া অবতীর্ণ হইলেন, এবং নিরতিশয় নির্বন্ধ সহকারে, তাহার এরূপ বিপৎপ্রাপ্তির কারণ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। সে কিছুই উত্তর দিল না। রাজা, ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, যক্ষের নিকট যে তৈলিকের উপাখ্যান শুনিয়াছিলাম, এ সেই ব্যক্তি; আর, যোগীও সেই কুম্ভকার, আপনি যোগসিদ্ধির উদ্দেশে, ইহার প্রাণসংহার করিয়া, শ্মশানে রাখিয়াছে। অনন্তর তিনি, শবকে উত্তরীয়বস্ত্ৰে বদ্ধ করিয়া, যোগীর নিকটে লইয়া চলিলেন।
অর্ধপথে উপস্থিত হইলে, শবাবিষ্ট বেতাল বিক্ৰমাদিত্যকে জিজ্ঞাসিল, অহে বীর পুরুষ! তুমি কে, আমায়, কি নিমিত্তে, কোথায়, লইয়া যাইতেছ, বল। ভূপতি কহিলেন, আমি রাজা বিক্ৰমাদিত্য; শান্তশীল নামক যোগীর আদেশ অনুসারে, তোমায় তাঁহার আশ্রমে লইয়া যাইতেছি। বেতাল কহিল, মহারাজ! মূঢ়, নিৰ্বোধ, ও অলসেরা কেবল নিদ্রায়, আলস্যে ও কলহে কালাহরণ করে; কিন্তু বুদ্ধিমান, চতুর, পণ্ডিত ব্যক্তিরা, সদা সদালাপ, শাস্ত্রচিন্তা, ও সৎকর্মের অনুষ্ঠান দ্বারা, আনন্দে কালযাপন করিয়া থাকেন। অতএব, সমস্ত পথ মৌনভাবে গমন করা অপেক্ষা, সৎকথার আলোচনা শ্ৰেয়সী বোধ করিয়া, এক এক প্রসঙ্গ করিতেছি, শ্রবণ কর। প্রত্যেক প্রসঙ্গের পরিশেষে প্রশ্ন করিব; যদি তুমি তত্তৎ প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর দাও, তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া যাইব; আর, যদি জানিয়াও যথার্থ উত্তর না দাও, অবিলম্বে তোমার বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ হইবেক। রাজা, অগত্যা তদীয় প্রস্তাবে সন্মত হইয়া, তাহাকে সন্ন্যাসীর আশ্রমে লইয়া চলিলেন এবং বেতালও উপাখ্যানের আরম্ভ করিল।
০১. প্রথম উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ! শ্রবণ কর,