এইরূপ উপদেশ দিয়া, যক্ষ স্বস্থানে প্ৰস্থান করিল। রাজাও শুনিয়া, ত্ৰস্ত ও বিস্ময়গ্ৰস্ত হইয়া, নানাপ্রকার চিন্তা করিতে করিতে, রাজবাটীতে প্রবিষ্ট হইলেন। পর দিন প্রভাতে, তিনি সিংহাসনে উপবিষ্ট হইলে, ভৃত্যগণ ও প্ৰজাবৰ্গ, বহুদিনের পর, রাজসন্দর্শন প্ৰাপ্ত হইয়া, আনন্দপ্রবাহে মগ্ন হইল। রাজা বিক্ৰমাদিত্য, রাজনীতির অনুবর্তী হইয়া, রাজ্যশাসন ও প্ৰজাপালন করিতে লাগিলেন।
কিছুদিন পরে, শান্তশীল নামে এক সন্ন্যাসী, শ্ৰীফল হস্তে রাজসভায় উপস্থিত হইলেন এবং শ্ৰীফলপ্ৰদানপূর্বক রাজাকে আশীৰ্বাদ করিয়া, কক্ষস্থিত আসন পাতিয়া, তদুপরি উপবেশন করিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ কথোপকথন করিয়া, রাজার নিকট বিদায় লইয়া, সন্ন্যাসী সভা হইতে প্ৰস্থান করিলে পর, তিনি অন্তঃকরণে এই বিতর্ক করিতে লাগিলেন, যক্ষ যে সন্ন্যাসীর কথা কহিয়াছিল, এ সেই ব্যক্তি কিনা। যাহা হউক, সহসা শ্ৰীফলভক্ষণ করা উচিত নহে। রাজা, মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, কোষাধ্যক্ষের হন্তে সমর্পণপূর্বক কহিলেন, তুমি এই শ্ৰীফল সাবধানে রাখিবে। সন্ন্যাসী প্ৰত্যহ রাজদর্শন ও শ্ৰীফলপ্ৰদান করিতে লাগিলেন।
এক দিবস রাজা, বয়স্যবর্গ সমভিব্যাহারে, মন্দুরাসিন্দর্শনার্থ গমন করিয়াছেন, এমন সময়ে সন্ন্যাসী তথায় উপস্থিত হইয়া, পূর্ববং শ্ৰীফলপ্রদানপূর্বক, আশীৰ্বাদ করিলেন। দৈবযোগে, শ্ৰীফল ভূপতির করতল হইতে ভূতলে পতিত ও ভগ্ন হওয়াতে, তন্মধ্য হইতে এক অপূর্ব রত্ন নিৰ্গত হইল। রাজা ও রাজবয়স্যগণ তদীয় প্ৰভা দর্শনে চমৎকৃত হইলেন। রাজা যোগীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয়। আপনি কি জন্যে আমায় এই রত্নগর্ভ শ্ৰীফল দিলেন।
যোগী কহিলেন, মহারাজ! শাস্ত্রে রাজা, গুরু, জ্যোতির্বিদ, ও চিকিৎসকের নিকট রিক্ত হস্তে যাইতে নিষেধ আছে; এইজন্যে, আমি এই রত্নগৰ্ভ শ্ৰীফল লইয়া আসিয়াছিলাম। আর, এক রত্নগৰ্ভ শ্ৰীফলের কথা কি কহিতেছেন, প্রতিদিন আপনাকে যে শ্ৰীফল দিয়াছি, সকলের মধ্যেই এতাদৃশ এক এক রত্ন আছে। তখন রাজা কোষাধ্যক্ষকে ডাকাইয়া কহিলেন, তোমাকে যত শ্ৰীফল রাখিতে দিয়াছি, সমুদয় এই স্থানে আন। কোষাধ্যক্ষ, রাজকীয় আদেশ অনুসারে, সমস্ত শ্ৰীফল তথায় উপস্থিত করিলে, রাজা প্রত্যেক শ্রীফল ভাঙ্গিয়া, সকলের মধ্যেই এক এক রত্ন দেখিয়া যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত ও চমৎকৃত হইলেন এবং, তৎক্ষণাৎ রাজসভায় গমনপূর্বক, এক মণিকারকে ডাকাইয়া, ঐ সমস্ত রত্বের পরীক্ষা করিতে আজ্ঞা দিয়া কহিলেন, এই অসার সংসারে ধর্মই সার পদার্থ; অতএব, তুমি ধর্মপ্রমাণ প্রত্যেক রত্বের মূল্য নির্ধারিত করিয়া দাও।
এইরূপ রাজবাক্য শ্রবণগোচর করিয়া, মণিকার কহিল, মহারাজ! আপনি যথার্থ আজ্ঞা করিয়াছেন। ধর্মরক্ষা করিলে, সকল বিষয়ের রক্ষা হয়; ধর্মলোপ করিলে সকল বিষয়ের লোপ হয়। অতএব, আমি ধৰ্মীসাক্ষী করিয়া প্ৰতিজ্ঞা করিতেছি, আপন জ্ঞান অনুসারে, যথার্থ মূল্য নির্ধারিত করিয়া দিব। ইহা কহিয়া, সে প্রত্যেক রত্নের লক্ষণপরীক্ষা করিয়া কহিল, মহারাজ! বিলক্ষণ বিবেচনা করিয়া দেখিলাম, সকল রত্নই সর্বাঙ্গসুন্দর; কোটি মুদ্রাও একৈকের প্রকৃত মূল্য নহে। এ সকল অমূল্য রত্ন।
রাজা শুনিয়া, সাতিশয় হৃষ্ট হইয়া, সমুচিত পারিতোষিক প্রদানপূর্বক, মণিকারকে বিদায় করিলেন এবং, হস্তদ্বারা সন্ন্যাসীর হস্তগ্রহণ করিয়া, সিংহাসনার্থে উপবেশন করাইয়া কহিলেন, মহাশয়! আমার, সমস্ত সাম্রাজ্যও আপনকার প্রদত্ত রত্নসমূহের তুল্যমূল্য হইবেক না। আপনি, সন্ন্যাসী হইয়া এ সকল অমূল্য রত্ন কোথায় পাইলেন, এবং কি অভিপ্ৰায়েই বা আমায় দিলেন, জানিতে ইচ্ছা করি। যোগী কহিলেন, মহারাজ! ঔষধ, মন্ত্রণা, গৃহচ্ছিদ্র, এসকল সর্বসমক্ষে ব্যক্ত করা বিধেয় নহে; যদি অনুমতি হয়, নির্জনে গিয়া নিবেদন করি। মহারাজ! নীতিজ্ঞেরা বলেন, মন্ত্রণা, ষট্ কৰ্ণে প্রবিষ্ট হইলে, অপ্রকাশিত থাকে না, তাহাতে কাৰ্যহানির সম্পূর্ণ সম্ভাবনা; চারিকর্ণে হইলে, প্রকাশিত হয় না, অথচ কাৰ্যসিদ্ধি করে; আর, দুই কর্ণের মন্ত্রণা, মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক, ব্ৰহ্মাও জানিতে পারেন না।
ইহা শুনিয়া, রাজা সন্ন্যাসীকে নির্জনে লইয়া কহিতে লাগিলেন, যোগীশ্বর। আপনি আমায় এত রত্ন দিলেন, কিন্তু একদিনও আমার আলয়ে ভোজন বা জলগ্রহণ করিলেন না; এজন্য, আমি আপনকার নিকট অতিশয় লজ্জিত হইতেছি। আপনকার কোনও অভিপ্রায় থাকে, ব্যক্ত করুন: আমি প্রাণান্তেও তৎসম্পাদনে পরাঙ্মুখ হইব না। সন্ন্যাসী কহিলেন, মহারাজ! গোদাবরীতীরবর্তী শ্মশানে মন্ত্র সিদ্ধ করিবার সঙ্কল্প করিয়াছি; তাহাতে অষ্টসিদ্ধি লাভ হইবেক। অতএব, তোমার নিকট আমার প্রার্থনা এই, তুমি একদিন, সন্ধ্যা অবধি প্রভাত পর্যন্ত, আমার সন্নিহিত থাকিবে। তুমি সন্নিহিত থাকিলেই, আমার মন্ত্র সিদ্ধ হইবেক। রাজা কহিলেন, অবধারিত যাইব; আপনি দিন নির্ধারিত করিয়া বলুন। সন্ন্যাসী কহিলেন, তুমি, আগামী ভাদ্রীকৃষ্ণচতুর্দশীতে, সন্ধ্যাকালে, একাকী আমার নিকটে যাইবে। রাজা কহিলেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকিবেন; আমি, নিঃসন্দেহ, যথাসময়ে, আপনকার আশ্রমে উপস্থিত হইব। এইরূপে রাজাকে বচনবদ্ধ করিয়া, বিদায় লইয়া, সন্ন্যাসী স্বীয় আশ্রমে প্ৰতিগমন করিলেন।