এই রাজবাক্য নগর মধ্যে প্রচারিত হইলে, এক প্রসিদ্ধ বারবনিতা, নৃপতিসমীপে আসিয়া, নিবেদন করিল, মহারাজ! আজ্ঞা পাইলে, আমি, ঐ তাপসীর ঔরসে পুত্র জন্মাইয়া, ঐ পুত্র তাহার স্কন্ধে দিয়া, আপনকার সভায় আনিতে পারি। রাজা শুনিয়া সাতিশয় চমৎকৃত হইলেন এবং পরম সমাদরপূর্বক, বারনারীর উপর তাপসের আনয়নের ভারার্পণ করিলেন। সে ভূপালের নিয়োগ অনুসারে, যোগীর আশ্রমে উপস্থিত হইয়া দেখিল, যোগী যথার্থই মুদ্রিতনয়ন, অধঃশিরাঃ ও বৃক্ষে লম্বমান হইয়া, ধূমপান করিতেছেন; নিরতিশয় শীর্ণদেহ, কেহ কোনও প্রশ্ন করিলে উত্তর দেন না। তদ্দর্শনে বারযোষিৎ, সহসা সন্ন্যাসীর সমাধিভঙ্গ করা অসাধ্য জানিয়া তদীয় আশ্রমের অনতিদূরে এক সুশোভন উপবন ও তন্মধ্যে পরম রমণীয় বাসভবন নির্মিত করাইল এবং নানা উপায় চিন্তিয়া, পরিশেষে, যুক্তিপূর্বক, মোহনভোগ প্রস্তুত করিয়া, ধূমপায়ী তপস্বীর আস্যে অৰ্পিত করিল। তপস্বী, রসনাসংযোগ দ্বারা মিষ্ট বোধ হওয়াতে, ক্ৰমে ক্ৰমে সমুদয় ভক্ষণ করিলেন। বারাঙ্গনা পুনরায় দিল; তিনিও পুনরায় ভক্ষণ করিলেন।
এইরূপে, ক্ৰমাগত কতিপয় দিবস, মোহনভোগ উপযোগ করিয়া, শরীরে কিঞ্চিৎ বলসঞ্চার হইলে, সন্ন্যাসী, নেত্ৰদ্ধয় উল্মীলিত করিয়া, তরু হইতে অবতীর্ণ হইলেন, এবং বারনারীকে জিজ্ঞাসিলেন, তুমি কে, কি অভিপ্ৰায়ে, একাকিনী এই নির্জন বনস্থানে আগমন করিয়াছ। সে কহিল, আমি দেবকন্যা, দেবলোকে তপস্যা করি; সম্প্রতি, তীৰ্থপৰ্যটনপ্রসঙ্গে, পরম পবিত্র কর্মক্ষেত্র ভারতবর্ষে আসিয়া, যোগাভ্যাসবাসনায়, অনতিদূরে আশ্রমনির্মাণ করিয়াছি; নিয়ত তথায় অবস্থিতি করি। অদ্য সৌভাগ্যক্ৰমে, এই আশ্রমে প্রবেশ করিয়া, আপনকার সন্দর্শন ও সম্ভাষণানুগ্রহ দ্বারা, চরিতার্থতা প্রাপ্ত হইলাম। তপস্বী কহিলেন, আমি, তোমার সৌজন্য ও সুশীলতা দর্শনে, পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইয়াছি, এবং তোমার মধুর মূর্তি সন্দর্শনে আত্মাকে চরিতার্থ বোধ করিতেছি; যেহেতু জন্মান্তরীণ পুণ্যসঞ্চয় ব্যতিরেকে, সাধুসমাগম লব্ধ হয় না। যাহা হউক, তোমার আশ্রম দেখিবার নিমিত্ত, আমার অতিশয় বাসনা হইতেছে। যদি প্রতিবন্ধক না থাকে, ও অধিক দূরবর্তী না হয়, আমায় তথায় লইয়া চল।
বারবিলাসিনী, তপস্বীর অভ্যর্থনা শ্রবণে কৃতাৰ্থম্মন্য ও অতিমাত্র ব্যগ্ৰ হইয়া, তাঁহাকে আপন আলয়ে লইয়া গেল, এবং, সাতিশয় যত্ন ও সবিশেষ সমাদর পুরঃসর, নানাবিধ সুম্বাদ মিষ্টান্ন ও সুরস পানীয় প্রদান করিল। তিনি, বারনারীর কপটজালে বন্ধ হইয়া, তাহার দত্ত সমস্ত বস্তু ভক্ষণ ও পান করিলেন। এইরূপে, তপস্বী, ধূমপান পরিত্যাগপূর্বক, যোগাভ্যাসে জলাঞ্জলি দিয়া, বারবনিতার সহিত বিষয়বাসনায় কালব্যাপন করিতে লাগিলেন। বারাঙ্গনা গর্ভবতী ও যথাকালে পুত্রবতী হইল। কিছুদিন অতীত হইলে পর, সে সন্ন্যাসীর নিকট নিবেদন করিল, মহাশয়। বহু দিবস অতিক্রান্ত হইল, আমরা নিরন্তর কেবল বিষয়বাসনায় কালাহরণ করিলাম; এক্ষণে তীর্থযাত্রা দ্বারা দেহ পবিত্র করা উচিত।
বারবনিতা, এইরূপ প্রবঞ্চনা দ্বারা, তপস্বীকে সংজ্ঞাশূন্য করিয়া, তাঁহার স্কন্ধে পুত্রপ্রদানপূর্বক, চন্দ্ৰভানুর রাজধানীতে লইয়া চলিল। সে রাজসভার সমীপবৰ্তিনী হইলে, রাজা তাহাকে চিনিতে পারিয়া, এবং সন্ন্যাসীর স্কন্ধে পুত্ৰ দেখিয়া, সামাজিকদিগকে বলিলেন, দেখ দেখ, যে বারনারী যোগীর আনয়নবিষয়ে প্ৰতিজ্ঞা করিয়া গিয়াছিল, সে আপন প্রতিজ্ঞা পূৰ্ণ করিয়া আসিতেছে। আমি উহার অসম্ভব বুদ্ধিকৌশলে চমৎকৃত হইয়াছি। অধিক আর কি বলিব, এই বুদ্ধিমতী বারবনিতা চিরশুষ্ক নীরস তরুকে পল্লবিত এবং পুষ্পে ও ফলে সুশোভিত করিয়াছে। সামাজিকেরা কহিলেন, মহারাজ! যথার্থ আজ্ঞা করিতেছেন; এ সেই বারাঙ্গনাই বটে।
রাজা ও সভাসদগণের এইরূপ কথোপকথন শ্রবণে, সহসা বোধসুধাকরের উদয় হওয়াতে, সন্ন্যাসীর মোহান্ধকার অপসারিত হইল। তখন তিনি, পূর্বাপরপর্যালোচনা করিয়া, যৎপরোনাস্তি ক্ষোভ প্রাপ্ত হইলেন এবং আপনাকে বারংবার ধিক্কার দিয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, দুরাত্মা চন্দ্ৰভানু, ঐশ্বৰ্যমদে মত্ত ও ধর্মাধৰ্মজ্ঞানশূন্য হইয়া আমার তপস্যাভ্রংশের নিমিত্ত এই দুর্বিগাহ মায়াজাল বিস্তারিত করিয়াছিল। আমিও অতি অধম ও অবশেন্দ্ৰিয়; অনায়াসে স্বৈরিণীর মায়ায় মুগ্ধ হইয়া, চিরসঞ্চিত কর্মফলে বঞ্চিত হইলাম। অনন্তর, ক্ৰোধে কম্পান্বিতকলেবর হইয়া স্কন্ধস্থিত পুত্রকে ভূতলে নিক্ষিপ্ত করিয়া, তিনি তৎক্ষণাৎ তথা হইতে প্ৰস্থান করিলেন; অন্য এক অরণ্যে প্রবেশপূর্বক, পূর্ব অপেক্ষায় অধিকতর মনোযোগ ও অধ্যবসায় সহকারে, যোগসাধন করিতে লাগিলেন, এবং, কিয়াৎ কাল পরে, ঐ নরেশ্বরের মৃত্যুসাধন করিয়া, কৃতকাৰ্য হইলেন।
এইরূপে, আখ্যায়িকার সমাপন করিয়া, যক্ষ কহিল, মহারাজ! তুমি, ও রাজা চন্দ্ৰভানু, আর ঐ যোগী, এই তিন জন এক নগরে, এক নক্ষত্রে, এক লগ্নে, জন্মিয়াছিলো। তুমি, রাজবংশে জন্মগ্রহণ করিয়া পৃথিবীর রাজত্ব করিতেছ। চন্দ্ৰভানু, তৈলিকাগৃহে জন্মিয়া ভাগ্যক্রমে ভোগবতী নগরীর অধিপতি হইয়াছিল। আর, যোগী, কুম্ভকারকুলে উৎপন্ন হইয়া যত্নপূর্বক যোগসাধন করিয়া চন্দ্ৰভানুর প্রাণবধ করিয়াছে, এবং তাঁহাকে বেতাল করিয়া শ্মশানবর্তী শিরীষবৃক্ষে লন্বিত করিয়া রাখিয়াছে; এক্ষণে, অনন্যকর্মা হইয়া, তোমার প্রাণসংহার করিবার চেষ্টায় আছে; ইহাতে কৃতকাৰ্য হইলেই, উহার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়। যদি তুমি তাহার হস্ত হইতে নিস্তার পাও, বহুকাল অকণ্টকে রাজ্যভোগ করিতে পরিবে। আমি, সবিশেষ সমস্ত কহিয়া, তোমায় সতর্ক করিয়া দিলাম; তুমি এ বিষয়ে ক্ষণমাত্রও অনবহিত থাকিবে না।