এ দিকে, অনঙ্গমঞ্জরীও, অনঙ্গশরপ্ৰহারে জর্জরিতাঙ্গী হইয়া, ধরাশয্যা অবলম্বন করিলে, তাহার সখী, সবিশেষ জিজ্ঞাসা দ্বারা, সমস্ত অবগত হইয়া, প্ৰবোধদানচ্ছলে, অনেক ভর্ৎসনা করিল। তখন সে কহিল, সখি! আমি নিতান্ত অবোধ নহি; কিন্তু মন আমার প্রবোধ মানিতেছে না। নির্দয় কন্দৰ্পের নিরন্তর শরপ্ৰহারে আমি জর্জরিত হইয়াছি। আর যাতনা সহ্য হয় না। যদি সেই চিত্তচোরকে ধরিয়া দিতে পার, তবেই প্ৰাণধারণ করিব; নতুবা, নিঃসন্দেহ, আত্মঘাতিনী হইব।
ইহা কহিয়া, অনঙ্গমঞ্জরী, অশ্রুপূর্ণ নয়নে, অবিশ্রান্ত দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিল। তাহার সহচরী, কালবিলম্ব অনুচিত বিবেচনা করিয়া, কমলাকরের আলয়ে গমনপূর্বক, তাহাকেও স্বীয় সহচরীর তুল্যাবস্থ দেখিয়া, মনে মনে কহিতে লাগিল, দুরাত্মা কন্দৰ্পের কিছুই অসাধ্য নাই; কি স্ত্রী, কি পুরুষ, সকলকেই, সমান রূপে, স্বীয় কুসুমময় শরাসনের বশবর্তী করিয়া রাখিয়াছে। অনন্তর, সে কমলাকরের নিকটে বলিল, অর্থদত্ত শেঠের কন্যা অনঙ্গমঞ্জরী প্রার্থনা করিতেছে, তুমি তাহারে প্ৰাণদান কর। কমলাকর, শ্রবণমাত্র অতি মাত্র উল্লাসিত হইয়া, গাত্রোত্থান করিল, এবং কহিল, আপাততঃ তুমি, এই অমৃতবৰ্ষী মনোহর বাক্য দ্বারা, আমায় প্ৰাণদান করিলে।
তৎপরে সহচরী, কমলাকরকে সমভিব্যাহারে লইয়া, অনঙ্গমঞ্জরীর বাসগৃহে উপস্থিত হইয়া দেখিল, সে প্ৰাণত্যাগ করিয়াছে। অমনি কমলাকর, হা প্রেয়সি! বলিয়া, দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্বক, ভূতলে পতিত ও তৎক্ষণাৎ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল।
অনঙ্গমঞ্জরীর গৃহজন, আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হইয়া, উভয়কে শ্মশানে লইয়া, একচিতায় অগ্নিদান করিল। দৈবযোগে, অর্থদত্তের জামাতা মদনদাসও, সেই সময়ে, শ্বশুরালয়ে উপস্থিত হইল; এবং, নিজ ভার্যা অনঙ্গমঞ্জরীর মৃত্যুবৃত্তান্ত শুনিয়া, হাহাকার করিতে করিতে, উর্ধ্বশ্বাসে শ্মশানে গিয়া, জ্বলন্ত চিতায় ঝম্পপ্রদানপূর্বক, প্রাণত্যাগ করিল।
ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! এই তিনের মধ্যে কোন ব্যক্তি অধিক ইন্দ্ৰিয়দাস। রাজা কহিলেন, মদনদাস। বেতাল কহিল, কেন। রাজা কহিলেন, অনঙ্গমঞ্জরী, পরপুরুষে অনুরাগিণী হইয়া, তাহার বিরহে প্রাণত্যাগ করিল; তাহাতে মদনদাসের অন্তঃকরণে অণুমাত্র বিরাগ জন্মিল না; প্রত্যুত, তদীয় মৃত্যুশ্রবণে প্রাণধারণে অসমর্থ হইয়া, অগ্নিপ্ৰবেশ করিল।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।
২১. একবিংশ উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ!
জয়স্থল নগরে, বিষ্ণুস্বামী নামে, ধর্মাত্মা ব্ৰাহ্মণ ছিলেন। তাঁহার চারি পুত্র; জ্যেষ্ঠ দ্যূতাসক্ত; মধ্যম লম্পট; তৃতীয় নির্লজ্জ; চতুর্থ নাস্তিক। ব্ৰাহ্মণ, পুত্ৰগণের গৰ্হিত ব্যবহার ও কদাচার দর্শনে সাতিশয় বিরক্ত হইয়া, এক দিন, চারি জনকে একত্র করিয়া এইরূপ ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন;— যে ব্যক্তি দ্যূতক্রীড়ায় আসক্ত হয়, কমলা, ভ্ৰান্তিক্ৰমেও, তার প্রতি কৃপাদৃষ্টি করেন না। ধর্মশাস্ত্ৰে লিখিত আছে, নাসাকর্ণচ্ছেদনপূর্বক, গর্দভে আরোহণ করাইয়া, দ্যূতাসক্ত ব্যক্তিকে দেশ হইতে বহিষ্কৃত করিবেক। দ্যূতাসক্ত ব্যক্তি হিতাহিতবিবেচনারহিত ও ধর্মাধৰ্মজ্ঞানশূন্য হয়। ধর্মানন্দন রাজা যুধিষ্ঠির, দ্যূতাসক্ত হইয়া, সাম্রাজ্য ও ভার্যা পর্যন্ত হারাইয়া, পরিশেষে, দুঃসহ বনবাসক্লেশে কালযাপন করিয়াছিলেন। আর, যে ব্যক্তি লম্পট হয়, সে সুখভ্রমে দুঃখাৰ্ণবে প্রবেশ করে। লম্পটের, ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তি উদ্দেশে সর্বস্বান্ত করিয়া, অবশেষে, চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করিয়া থাকে। লম্পট ব্যক্তির আচার, বিচার, নিয়ম, ধর্ম, সমস্তই নষ্ট হয়। আর, যে ব্যক্তি নির্লজ্জ, তাহাকে ভর্ৎসনা করা বা উপদেশ দেওয়া বৃথা। তাহার লোকনিন্দার ভয় থাকে না, এবং, গহিত কর্ম করিয়াও, লজ্জাবোধ হয় না। এবংবিধ ব্যক্তির যত শীঘ্ৰ মৃত্যু হয়, ততই পৃথিবীর মঙ্গল। আর, যে ব্যক্তি পরকালের ভয় না করে, দেবতা ও গুরুজনে ভক্তিমান ও শ্রদ্ধাবান না হয়, এবং সনাতন বেদাদি শাস্ত্ৰে আস্থাশূন্য হয়, সে অতি পাষণ্ড; তাহার সহিত বাক্যালাপ করিলেও, অধৰ্মগ্ৰস্ত হইতে হয়। লোকে, পুত্রের মঙ্গলপ্রার্থনায়, জপ, তপ, দান, ধ্যান, ব্ৰত, উপবাস আদি করে; কিন্তু আমি, কায়মনোবাক্যে, নিয়ত, তোমাদের মৃত্যুপ্রার্থনা করিয়া থাকি।
পিতার এইপ্ৰকার তিরষ্কারবাক্য শ্রবণগোচর করিয়া, চারি জনেরই অন্তঃকরণে অত্যন্ত ঘৃণা জন্মিল। তখন তাহারা পরস্পর কহিতে লাগিল, বাল্যকালে বিদ্যাভ্যাসে ঔদাস্য করিয়াছিলাম, তাহাতেই আমাদের এই দুরবস্থা ঘটিয়াছে; এক্ষণে, বিদেশে গিয়া, প্ৰাণপণে যত্ন করিয়া, বিদ্যাভ্যাস করা উচিত। এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া, চারি জনে, নানাদেশে ভ্রমণপূর্বক, অল্পকালমধ্যে, নানা বিদ্যায় পারদর্শী হইল। গৃহপ্ৰতিগমনকালে, তাহারা পথিমধ্যে দেখিতে পাইল, এক চর্মকার, মৃত ব্যাঘ্রের মাংস ও চর্ম লইয়া, প্ৰস্থান করিল; কেবল অস্থি সকল স্থানে স্থানে পতিত রহিল।
তাহাদের মধ্যে, একজন অস্থিসঙ্ঘটনী বিদ্যা শিখিয়াছিল; সে, বিদ্যাপ্রভাবে, সমস্ত অস্থি একস্থানস্থ করিয়া, ব্যাঘ্রের কঙ্কালসঙ্কলন করিল। দ্বিতীয়, মাংসসঞ্জননী বিদ্যা দ্বারা, ঐ কঙ্কালে মাংস জন্মাইয়া দিল। তৃতীয় চর্মযোজনী বিদ্যা শিখিয়াছিল; সে, তৎপ্রভাবে, শার্দুলের সর্বশরীর চর্ম দ্বারা আচ্ছাদিত করিল। অনন্তর, চতুৰ্থ, মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা দ্বারা, প্ৰাণদান করিলে, ব্যাঘ্র, তৎক্ষণাৎ, তাহাদের চারি সহোদরেরই প্ৰাণসংহার করিল।