এই অবসরে, ঋষিও, বনান্তর হইতে ফল, পুষ্প, কুশ, সমিধ প্রভৃতির আহরণ করিয়া, প্রত্যাবৃত্ত হইলেন। রাজা, দর্শনমাত্র, আত্মপরিচয়প্রদানপূর্বক, সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত করিলে, ঋষি অভীষ্টসিদ্ধিৰ্ভবতু বলিয়া আশীৰ্বাদ করিলেন। রাজা, আশীৰ্বাদশ্রবণে, মনে মনে দুষ্ট অভিসন্ধি করিয়া, কৃতাঞ্জলি হইয়া, নিবেদন করিলেন, মহাশয়! আমরা চিরকাল শুনিয়া আসিতেছি, ঋষিবাক্য কস্মিন্ কালেও ব্যর্থ হয় না। আপনি আশীৰ্বাদ করিলেন আমার অভিলাষ পূর্ণ হউক, কিন্তু, আমি তাহার কোনও সম্ভাবনা দেখিতেছি না। ঋষি কহিলেন, আমি বলিতেছি, অবশ্যই তোমার অভিলাষ হইবেক। তখন রাজা অম্নান বদনে বলিলেন, আমি এই কন্যার পাণিগ্রহণের অভিলাষ করিয়াছি।
ঋষি, রাজার দুরভিপ্রায়শ্রবণে, মনে মনে নিরতিশয় কুপিত হইয়াও, স্বীয় আশীৰ্বাদবাক্যের বৈয়র্থ্যপরিহারের নিমিত্ত, রাজাকে কন্যাসম্প্রদান করিলেন। রাজা, নব প্ৰণয়িনীকে সমভিব্যাহারিণী করিয়া, রাজধানী অভিমুখে চলিলেন। পথিমধ্যে রজনী উপস্থিত হইল। রাজা ও রাজপ্রেয়সী, যথাসম্ভব ফলমূল আদি দ্বারা, কথঞ্চিৎ ক্ষুধানিবৃত্তি করিয়া, তরুতলে শয়ন করিলেন।
অর্ধারাত্র সময়ে, এক দুর্দান্ত রাক্ষস আসিয়া, রাজাকে জাগরিত করিয়া, কহিল, আমি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হইয়া আসিয়াছি, তোমার। ভাৰ্যাকে ভক্ষণ করিব। রাজা কহিলেন, তুমি আমার প্রাণাধিক প্ৰেয়সীর প্রাণহিংসায় বিরত হও। অন্য যাহা চাহিবে, তাহাই দিব। তখন রাক্ষস কহিল, যদি তুমি, প্রশস্ত মনে, স্বহস্তে দ্বাদশবর্ষীয় ব্ৰাহ্মণকুমারের মস্তকচ্ছেদন করিয়া, আমার হস্তে দিতে পার, তাহা হইলে তোমার প্রিয়তমার প্রাণবধে ক্ষান্ত হই। রাজা, প্ৰিয়তমার প্রাণরক্ষার্থে, ব্ৰহ্মহত্যাতেও সম্মত হইলেন; এবং কহিলেন, তুমি সপ্তম দিবসে, আমার রাজধানীতে যাইবে; সেইদিন, আমি তোমার অভিলষিত সম্পন্ন করিব।
এইরূপে রাজাকে ব্ৰহ্মবধ প্ৰতিজ্ঞায় আবদ্ধ করিয়া, রাক্ষস প্ৰস্থান করিল। রাজাও, প্রভাত হইবামাত্র, প্ৰেয়সী সমভিব্যাহারে, রাজধানীতে গিয়া, প্রধানমন্ত্রীর সমক্ষে রাক্ষস বৃত্তান্তের বর্ণনা করিলেন। মন্ত্রী কহিলেন, মহারাজ। আপনি, ও জন্যে উৎকণ্ঠিত হইবেন না; আমি অনায়াসে উহা সম্পন্ন করিয়া দিব। রাজা, মন্ত্রিবাক্যে নির্ভর করিয়া, নিশ্চিন্ত হইয়া, নবপ্রণয়িনীর সহিত, পরম সুখে কালব্যাপন করিতে লাগিলেন।
মন্ত্রী, এক পুরুষপ্রমাণ কাঞ্চনময়ী প্রতিমা নির্মিত করাইয়া, মহামূল্য অলঙ্কারে মণ্ডিত করিয়া, নগরের চতুষ্পপথে স্থাপিত করিলেন, এবং প্রচার করিয়া দিলেন, যে ব্ৰাহ্মণ, বলিদানার্থে, স্বীয় দ্বাদশবৰ্ষীয় পুত্র দিবেন, তিনি এই প্রতিমা পাইবেন। এক অতি দরিদ্র ব্ৰাহ্মণের দ্বাদশবৰ্ষীয় পুত্র ছিল। তিনি, ঘোষণার বিষয় অবগত হইয়া, ব্ৰাহ্মণীকে বলিলেন, দেখ, নির্ধন ব্যক্তির সংসারাশ্রমে বাস করা বিড়ম্বনামাত্র। ধনই সকল ধর্মের ও সকল সুখের মূল। আমি জন্মদারিদ্র; এ পর্যন্ত, সাংসারিক কোনও সুখের মুখ দেখিতে পাইলাম না। এক্ষণে, ধনাগমের এই এক সহজ উপায় উপস্থিত। যদি তুমি মত কর, পুত্ৰ দিয়া স্বর্ণময়ী প্রতিমা লইয়া আসি; তাহা হইলে, যত দিন বাঁচিব, পরম সুখে কালযাপন করিতে পারিব।
ব্ৰাহ্মণী, সন্মত হইলেন। ব্ৰাহ্মণ, পুত্ৰ দিয়া, প্রতিমা লইয়া, তদ্বিক্রয় দ্বারা ধনসংগ্ৰহ করিলেন। সপ্তম দিনে, প্রত্যুষ সময়ে, রাক্ষস রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিবামাত্র, মন্ত্রী, দ্বাদশবৰ্ষীয় ব্রাহ্মণকুমার ও তীক্ষ্নধার খড়গ আনিয়া, রাজার সম্মুখে রাখিলেন। অনন্তর, রাজা শিরশেছদনাৰ্থে খড়্গ উত্তোলিত করিলে, ব্ৰাহ্মণকুমার, অবনত বদনে, ঈষৎ হাস্য করিল। রাজা, অম্লান বদনে, তাহার মস্তকচ্ছেদন করিলেন। তদীয় ছিন্ন মস্তক রাক্ষসের হস্তে অপিত হইল।
ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! মৃত্যুসময়ে সকলে রোদন করিয়া থাকে; বালক হাস্য করিল কেন, বল। রাজা কহিলেন, বাল্যকালে পিতামাতা প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করেন; তৎপরে, কোনও বিপদ ঘটিলে, রাজা রক্ষা করিয়া থাকেন; কিন্তু, আমার ভাগ্যদোষে, সকলই বিপরীত হইল। পিতা মাতা অর্থলোভে বিক্রয় করিলেন; প্রাণভয়ে যে রাজার শরণাগত হইব, তিনিই স্বয়ং মস্তকচ্ছেদনে উদ্যত। মনে মনে এই আলোচনা করিয়া, সে হাস্য করিয়াছিল।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।
২০. বিংশ উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ!
বিশালপুর নগরে, অর্থদত্ত নামে, ধনাঢ্য বণিক ছিলেন। তিনি, কমলপুরবাসী মদনদাস বণিকের সহিত, আপন কন্যা অনঙ্গমঞ্জরীর বিবাহ দিয়াছিলেন। কিছু দিন পরে, মদনদাস, ভাৰ্যাকে তদীয় পিত্ৰালয়ে রাখিয়া, বাণিজ্যার্থে দেশান্তরে প্ৰস্থান করিল।
এক দিন, অনঙ্গমঞ্জরী, গবাক্ষ দ্বারা, রাজপথনিরীক্ষণ করিতেছে; এমন সময়ে, কমলাকর নামে, সুকুমার ব্রাহ্মণকুমার তথায় উপস্থিত হইল। উভয়ের নয়নে নয়নে আলিঙ্গন হইলে, পরস্পর পরস্পরের রূপলাবণ্যদর্শনে মোহিত হইল। ব্ৰাহ্মণকুমার, নিকাম ব্যাকুল হইয়া, গৃহগমনপূর্বক, প্রিয় বয়স্যের নিকট স্বীয় বিরহবেদনার নির্দেশ করিয়া, বিচেতন ও শয্যাগত হইল। তাহার সখা, উশীরানুলেপন, চন্দনবারিসেচন, সরসকমলদলশয্যা, জলার্দ্রতালবৃন্তসঞ্চালন প্রভৃতি দ্বারা, শুশ্রূষা করিতে লাগিল।