মোহিনী গর্ভবতী ও যথাকালে পুত্রবতী হইল। সূতিকাষষ্ঠীর রজনীতে, সে স্বপ্নে দেখিল, দুই হস্ত, পঞ্চ মস্তক, প্রতি মস্তকে তিন তিন চক্ষুঃ ও এক এক অর্ধচন্দ্ৰ, অতি দীর্ঘ জটাভার পৃষ্ঠদেশে লম্বমান, দক্ষিণ হস্তে ত্রিশূল, বাম হস্তে নরকপাল, ব্যাঘ্রচর্ম পরিধান, ভুজঙ্গের মেখলা, উজ্জ্বল রজতগিরির ন্যায় কলেবর, অতিশুভ্ৰ নাগযজ্ঞোপবীত, সৰ্বাঙ্গ ভস্মভূষিত; এবংবিধ আকার ও বেশ বিশিষ্ট বৃষভারূঢ় এক পুরুষ, তাহার সম্মুখে আসিয়া, কহিতেছেন, বৎসে মোহিনী! তোমার পুত্র জন্মিয়াছে, এজন্য আমি অতিশয় আহ্লাদিত হইয়াছি। এই বালক ক্ষণজন্ম। তুমি, আমার আজ্ঞা অনুসারে, ঐ শিশুকে, সহস্ৰ সুবৰ্ণ সহিত, পেটকের মধ্যগত করিয়া, কল্য অর্ধারাত্র সময়ে, রাজদ্বারে রাখিয়া আসিবে। রাজা তাহার, পুত্রনির্বিশেষে, প্রতিপালন করিবেন। রাজার স্বৰ্গারোহণের পর, তোমার পুত্র, তদীয় সিংহাসনে অধিরূঢ় হইয়া, ক্ৰমে ক্ৰমে, নিজ প্ৰতাপে ও নীতিবিদ্যাপ্রভাবে, সসাগর সদ্বীপা পৃথিবীর অদ্বিতীয় অধিপতি হইবেক।
মোহিনীর নিদ্রাভঙ্গ হইল। সে সমস্ত স্বপ্নবৃত্তান্ত স্ত্রীয় জননীর গোচর করিল। ধনবতী শুনিয়া নিরতিশয় আনন্দিত হইল; এবং, পর দিন নিশীথসময়ে, ঐ শিশুকে, সহস্ৰ স্বর্ণমুদ্রা সহিত, পেটকের মধ্যে স্থাপিত করিয়া, রাজদ্বারে রাখিয়া আসিল। সেই সময়ে, রাজাও স্বপ্নে দেখিতেছেন, পূর্বোক্তপ্রকার পুরুষ, তাহার সম্মুখবর্তী হইয়া, কহিতেছেন, মহারাজ! গাত্ৰোত্থান কর; এক পেটকমধ্যশায়ী চক্ৰবর্তিলক্ষণাক্রান্ত সন্তান তোমার দ্বারদেশে উপনীত। অবিলম্বে উহারে আনিয়া, পুত্রনির্বিশেষে, প্ৰতিপালন কর। উত্তর কালে, সেই তোমার উত্তরাধিকারী হইবেক।
রাজার নিদ্রাভঙ্গ হইল। তখন তিনি, রাজমহিষীকে জাগরিত করিয়া, স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনাইলেন। অনন্তর, উভয়ে, দ্বারদেশে গিয়া পেটক পতিত দেখিয়া, যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হইলেন, এবং তৎক্ষণাৎ পেটকের মুখ উদ্ঘাটিত করিয়া দেখিলেন, বালকের রূপে পেটক আলোকপূৰ্ণ হইয়া আছে। রাজ্ঞী, সেই শিশুকে ক্ৰোড়ে লইয়া, অগ্ৰগামিনী হইলেন; রাজা, স্বর্ণমুদ্রাগ্রহণপূর্বক, তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন।
প্রভাত হইবামাত্র, রাজা, সামুদ্রিকবেত্তা পণ্ডিতগণকে আনাইয়া, দেবপ্রসাদলব্ধ বালকের লক্ষণপরীক্ষার্থে, আজ্ঞাপ্ৰদান করিলেন। তাঁহারা সেই শিশুকে দৃষ্টিগোচর করিয়া কহিলেন, মহারাজ! আপাততঃ তিন স্পষ্ট সুলক্ষণ দৃষ্ট হইতেছে; দীর্ঘ আকার, উন্নত ললাট, বিস্তৃত বক্ষঃস্থল। অনন্তর, তাঁহারা সবিশেষ পরীক্ষা করিয়া কহিলেন; সামুদ্রিক শাস্ত্রে পুরুষের দ্বাত্রিংশৎ শুভ লক্ষণ নির্দ্দিষ্ট আছে; মহারাজ!
সেই সমুদয় এই একাধারে লক্ষিত হইতেছে। এই বালক সমস্ত পৃথিবীর সম্রাট হইবেন, সন্দেহ নাই।
রাজা পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইলেন, এবং, পারিতোষিকপ্ৰদানপূর্বক, ব্রাহ্মণদিগকে বিদায় করিয়া, দীন, দরিদ্র, অনাথ প্রভৃতিকে প্রার্থনাধিক অর্থদান করিলেন। ষষ্ঠ মাসে অন্নপ্রাশন দিয়া, তিনি বালকের নাম হরদত্ত রাখিলেন। বালক, অল্পকালমধ্যে, চতুৰ্দশ বিদ্যায় পারদর্শী হইলেন; এবং, রাজার লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে, তদীয় সিংহাসনে অধিরোহণ করিয়া, ক্ৰমে ক্রমে, সমস্ত ভূমণ্ডলে একাধিপত্য স্থাপন করিলেন। কিয়ৎ কাল পরে, হরদত্ত, তীর্থযাত্রায় নিৰ্গত হইয়া, প্রথমতঃ, পিতৃকৃত্যসম্পাদনাৰ্থে, গয়াধামে উপস্থিত হইলেন। ফল্গু তীরে যথাবিধি শ্ৰাদ্ধ করিয়া, রাজা পিতৃপিণ্ডপ্রদানে উদ্যত হইলে, নদীর মধ্য হইতে, পিণ্ডগ্রহণার্থে, তিন জনের তিন দক্ষিণ হস্ত যুগপৎ নির্গত হইল; প্রথম ক্ষেত্রিক চোরের, দ্বিতীয় বীজী ব্ৰাহ্মণের, তৃতীয় প্রতিপালক রাজার।
ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! ইহাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি, শাস্ত্র ও যুক্তি অনুসারে, হরদত্ত-দত্ত পিণ্ডের অধিকারী হইতে পারে। রাজা বলিলেন, চোর। বেতাল কহিল, অন্যেরা কি অপরাধ করিয়াছে। রাজা বলিলেন, ব্ৰাহ্মণ, অর্থ লইয়া বীজবিক্রয় করিয়াছেন; রাজাও, সহস্ৰ সুবৰ্ণ লইয়া, প্রতিপালন করিয়াছেন; এজন্য তাঁহারা পিণ্ডগ্রহণে অধিকারী হইতে পারেন না।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।
১৯. উনবিংশ উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ!
চিত্ৰকুট নগরে রূপদত্ত নামে রাজা ছিলেন। তিনি, এক দিন, একাকী, অশ্বে আরোহণ করিয়া, মৃগয়ায় গমন করিলেন। মৃগের অন্বেষণে, বনে বনে অনেক ভ্ৰমণ করিয়া, পরিশেষে, তিনি এক ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। তথায় এক অতি মনোহর সরোবর ছিল। তিনি তাহার তীরে গিয়া দেখিলেন, কমল সকল প্রফুল্প হইয়া আছে; মধুকরেরা, মধুপানে মত্ত হইয়া, গুনগুন রবে গান করিতেছে; হংস, সারস, চক্রবাক প্রভৃতি জলবিহঙ্গগণ তীরে ও নীরে বিহার করিতেছে; চারিদিকে, কিসলয়ে ও কুসুমে সুশোভিত নানাবিধ পাদপসমূহ বসন্তলক্ষ্মীর সৌভাগ্যবিস্তার করিতেছে; সর্বতঃ, শীতল সুগন্ধ গন্ধবহের মন্দ মন্দ সঞ্চার হইতেছে। রাজা নিতান্ত পরিশ্রান্ত ছিলেন; বৃক্ষমূলে অশ্ববন্ধন করিয়া, তথায় উপবেশনপূর্বক, শ্ৰান্তি দূর করিতে লাগিলেন।
কিয়ৎ ক্ষণ পরে, এক ঋষিকন্যা আসিয়া স্নানার্থে সরোবরে অবগাহন করিল। রাজা, দর্শনমাত্র, অতিমাত্র মোহিত ও জ্ঞানরহিত হইলেন। স্নানক্রিয়ার সমাপন করিয়া, ঋষিতনয়া আশ্রমাভিমুখী হইলে, রাজা তাহার সম্মুখবর্তী হইয়া কহিলেন, ঋষিকন্যে! তোমার এ কেমন ধর্ম। আমি, আতপে তাপিত হইয়া, বিশ্রামার্থে তোমার আশ্রমে অতিথি হইলাম, তুমি এমনই আতিথেয়ী, যে সম্ভাষণ দ্বারাও, আমার সংবর্ধনা করিলে না। ঋষিতনয়া শুনিয়া দণ্ডায়মান হইলেন।