গুণাকর শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিল; এবং কহিল, এই মায়াময় সংসার অতি অকিঞ্চিৎকর। ইহাতে লিপ্ত থাকিলে, কেবল জন্মমৃত্যুপরম্পরারূপ দুর্ভেদ্য শৃঙ্খলে বদ্ধ থাকিতে হয়। প্ৰত্যক্ষ পরিদৃশ্যমান পদার্থমাত্ৰই মায়াপ্রপঞ্চ, বাস্তবিক কিছুই নহে। কে কাহার পিতা, কে কাহার মাতা, কে কাহার পুত্র। সকলই ভ্ৰান্তিমূলক। অতএব, আর আমি বৃথা মায়ায় মুগ্ধ হইব না; এবং, শ্ৰেয়ঃসাধন বোধ করিয়া, যে পথ অবলম্বন করিয়াছি, তাহা ছাড়িতে পারিব না। এই বলিয়া, পিতামাতার চরণে সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত করিয়া প্ৰস্থান করিল; এবং, সন্ন্যাসীর আশ্রমে উপস্থিত হইয়া, অগ্নিপ্রবেশপূর্বক, মন্ত্রসাধনে যত্ন করিতে লাগিল; কিন্তু কৃতকার্য হইতে পারিল না।
ইহা কহিয়া, বেতাল বিক্ৰমাদিত্যকে জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! কি কারণে, ব্ৰাহ্মণ সাধনা করিয়া সিদ্ধ হইতে পারিল না, বল। বিক্রমাদিত্য কহিলেন, একাগ্ৰচিত্ত না হইলে, মন্ত্র সিদ্ধ হয় না। ব্ৰাহ্মণের মনে একান্ত নিষ্ঠ ছিল না; সেই বৈগুণ্যবশতঃ, তাহার সাধনা বিফল হইল। ইহা শুনিয়া বেতাল কহিল, যে সাধক, মন্ত্র সিদ্ধ করিবার উদ্দেশে, এতাদৃশ ক্লেশ স্বীকার করিলেক, সে একাগ্ৰচিত্ত হয় নাই, তাহার প্রমাণ কি। বিক্ৰমাদিত্য কহিলেন, সে, একাগ্ৰচিত্ত হইলে, পিতামাতার নিমিত্ত চলচিত্ত হইত না; এবং, মধ্যে যোগে ভঙ্গ দিয়া, তাহাদের দর্শনে যাইত না। ফলতঃ, সকলই অদৃষ্টমূলক; নতুবা, যোগাভ্যাস দ্বারা, সর্বাংশে নির্মম ও জ্ঞানসম্পন্ন হইয়াও, কি নিমিত্তে সিদ্ধপ্রায় সাধনফলে বঞ্চিত হইল, বল।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।
১৮. অষ্টাদশ উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ!
কুবলয়পুরে, ধনপতি নামে, এক সঙ্গতিপন্ন বণিক ছিলেন। তিনি, ধনবতীনাম্নী নিজ কন্যার, গৌরীকালে, গৌরীদত্ত নামক ধনাঢ্য বণিকের সহিত বিবাহ দিলেন। কিয়ৎ কাল পরে, ধন্যবতীর এক কন্যা জন্মিল। গৌরীদত্ত কন্যার নাম মোহিনী রাখিলেন। কালক্রমে, তিনি লোকান্তর প্রাপ্ত হইলে, তদীয় জ্ঞাতিবর্গ, ধনবতীকে অসহায়িনী দেখিয়া, তাহার সর্বস্ব অপহরণ করিল। সে, নিতান্ত দুরবস্থাগ্রস্ত হইয়া, কন্যা লইয়া, এক তমিস্রা রজনীতে, পিত্ৰালয়ে প্রস্থান করিল।
কিয়ৎ দূর গমন করিয়া, পথ ভুলিয়া, উহার এক শ্মশানে উপস্থিত হইল। তথায় এক চোর, রাজদণ্ড অনুসারে, তিন দিন, শূলে আরোহিত ছিল; বিধিবিপাকে, সে পর্যন্ত, তাহার প্রাণপ্ৰয়াণ হয় নাই। দৈবযোগে, ধনবতীর দক্ষিণ কর চোরের চরণে লগ্ন হইলে, সে সাতিশয় ব্যথিত হইয়া কহিল, তুমি কে, কি নিমিতে, এমন দুঃখের সময়ে, আমায় মর্মান্তিক যাতনা দিলে। ধনবতী কহিল, জ্ঞানপূর্বক তোমাকে যাতনা দি নাই। যাহা হউক, আমার অপরাধ ক্ষমা কর। অনন্তর, আত্মপরিচয় দিয়া, সে চোরকে জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কে, কি নিমিত্তে শ্মশানে আছ, ও কিরূপ দুঃখভোগ করিতেছি, বল।
চোর কহিল, আমি বণিকজাতি, চৌর্যাপরাধে শূলে আরোহিত হইয়াছি; অন্য তৃতীয় দিবস, তথাপি প্ৰাণ নিৰ্গত হইতেছে না; তাহাতেই যার পর নাই যাতনাভোগ করিতেছি। জন্মকালে, জ্যোতির্বিদেরা, গণনা দ্বারা, স্থির করিয়াছিলেন, অবিবাহিত অবস্থায় আমার মৃত্যু হইবেক না। যাবৎ বিবাহ না হইতেছে, তাবৎ আমায়, এই অবস্থায়, দুঃসহ যাতনাভোগ করিতে হইবেক। যদি তুমি কৃপা করিয়া কন্যাদান কর, তবেই আমি এ অসহ্য যাতনা হইতে পরিত্রাণ পাই। আমার চিরসঞ্চিত সুবৰ্ণরাশি আছে; যদি আমার প্রার্থনা পূৰ্ণ কর, সমস্ত তোমায় দি।
ধনবতী, অৰ্থলোভে বিমূঢ় হইয়া, মনে মনে, মলিম্লুচের প্রার্থনায় সম্মতপ্রায় হইল; এবং কহিল, তুমি যে প্রস্তাব করিলে, তাহাতে আমার আপত্তি নাই; কিন্তু, আমার দৌহিত্রমুখদর্শনের ঐকান্তিক অভিলাষ আছে; তোমায় কন্যাদান করিলে, আমার সে অভিলাষ পূর্ণ হয় না। এ কথা শুনিয়া, চোর কহিল, তুমি এখন, কন্যাদান করিয়া, আমায় যাতনা হইতে মুক্ত কর। আমি অনুমতি দিতেছি, তোমার কন্যার বয়ঃপ্রাপ্তি হইলে, কোনও ব্রাহ্মণতনয়কে ধনদান দ্বারা সম্মত করিয়া, তাহা দ্বারা ক্ষেত্ৰজ পুত্ৰ উৎপন্ন করিয়া লইবে; তাহা হইলে, তোমারও বাসনা পূৰ্ণ হইল; আমিও দুঃসহ যাতনা হইতে পরিত্ৰাণ পাইলাম।
ধনবতী কন্যাসম্প্রদান করিল। তখন চোর কহিল, ঐ পুরোবর্তী গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে আমার গৃহ। গৃহের পূর্ব ভাগে, কুপের নিকট, এক বটবৃক্ষ দেখিতে পাইবে; তাহার মূলে আমার সমস্ত সম্পত্তি নিহিত আছে; যাইয়া গ্রহণ কর। ইহা কহিবামাত্র, চোরের প্রাণবিয়োগ হইল; ধনবতীও, চৌরনির্দ্দিষ্ট ন্যগ্ৰোধবৃক্ষের মূলখননপূর্বক, সমস্ত স্বর্ণমুদ্রা হস্তগত করিয়া, পিত্ৰালয়ে প্রস্থান করিল। পরে সে, পিতাকে আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত করাইয়া, তাহার হস্তে সম্পত্তিসমর্পণপূর্বক, তদীয় আবাসে অবস্থিতি করিতে লাগিল।
কালক্রমে, মোহিনী যৌবনবতী হইল। সে, এক দিন, স্বীয় সহচরীর সহিত, গবাক্ষ দিয়া রাথ্যানিরীক্ষণ করিতেছে; এমন সময়ে, দৈবযোগে, এক পরমসুন্দর বিংশতিবর্ষীয় ব্ৰাহ্মণতনয় তথায় উপস্থিত হইল। তাহাকে উন্নয়নগোচরণ করিয়া, মোহিনীর মন মোহিত হইল। তখন, সে আপন সহচরীকে কহিল, তুমি এই ব্ৰাহ্মণকুমারকে আমার মার নিকটে লইয়া যাও। সখী ব্ৰাহ্মণতনয়কে তাহার জননীর নিকট উপস্থিত করিলে, সে চৌরবৃত্তান্ত স্মরণ করিয়া, তাহাকে প্রার্থনারূপ অৰ্থ দিয়া, মোহিনীর পুত্ৰোৎপাদনাৰ্থে নিযুক্ত করিল।