নিরূপিত সময় উপস্থিত হইলে, গরুড় আসিয়া, চঞ্চুপুট দ্বারা জীমূতবাহনগ্রহণপূর্বক, নভোমণ্ডলে উড্ডীন হইয়া, মণ্ডলাকারে ভ্রমণ করিতে লাগিল। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, জীমূতবাহনের দক্ষিণবাহুস্থিত নামাঙ্কিত মণিময় কেয়ুর, শোণিতলিপ্ত হইয়া, মলয়াবতীর সম্মুখে পতিত হইল। মলয়াবতী, নামাক্ষরপরিচয় দ্বারা, প্রিয়তমের প্রাণাত্যয় স্থির করিয়া, শিরে করাঘাতপূর্বক, ভূতলে পতিত হইয়া, উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিল। তাহার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, কেয়ুর দর্শনে সাতিশয় বিষন্ন হইয়া, হাহাকার করিতে লাগিলেন। রাজা মলয়কেতু, চতুর্দিকে বহুসংখ্যক লোক প্রেরিত করিয়া, পরিশেষে স্বয়ং, পুত্ৰ সহিত, জীমূতবাহনের অন্বেষণে নির্গত হইলেন।
শঙ্খচূড়, কাত্যায়নীর আলয় হইতে, রাজপরিবারের কোলাহলশ্রবণ করিয়া, সবিশেষ অনুসন্ধান দ্বারা, জীমূতবাহনের অমঙ্গলবৃত্তান্ত অবগত হইয়া, অশ্রুপূর্ণ নয়নে পূর্বস্থানে উপস্থিত হইল; এবং, গরুড়কে সম্বোধন করিয়া, উচ্চৈঃস্বরে কহিতে লাগিল, অহে বিহঙ্গরাজ! তুমি, শঙ্খচূড়ক্রমে, রাজা জীমূতবাহনকে লইয়া গিয়াছ; উনি তোমার ভক্ষ্য নহেন। আমার নাম শঙ্খচূড়; অদ্য আমার বার। তুমি, তাহারে পরিত্যাগ করিয়া, আমায় ভক্ষণ কর; নতুবা, তোমায় সাতিশয় অধৰ্মগ্ৰস্ত হইতে হইবেক।
গরুড় শুনিয়া অতিশয় শঙ্কিত হইলেন; এবং মৃতকল্প জীমূতবাহনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, অহে মহাপুরুষ! তুমি কে, কি নিমিত্তে প্ৰাণদানে উদ্যত হইয়াছ। জীমূতবাহন আত্মপরিচয়প্রদানপূর্বক, কহিলেন, অদ্য বা অশব্দতান্তে, অবশ্যই মৃত্যু ঘটিবেক। যে ব্যক্তি, ক্ষণবিধ্বংসী তুচ্ছ শরীরের বিনিয়োগ দ্বারা, পরোপকার করিয়া, দিগন্তব্যাপিনী ও অনন্তকালস্থায়িনী কীর্তি উপার্জন করে, তাহারই এই সংসারে জন্মগ্রহণ সার্থক; নতুবা, স্বোদরপরায়ণ কাক, কুকুর, শৃগাল প্রভৃতি হইতে বিশেষ কি। এই বিবেচনায়, আমি, আত্মপ্রাণব্যয় দ্বারা, শঙ্খচূড়ের প্রাণরক্ষা করিতে আসিয়াছি। গরুড় শুনিয়া, যার পর নাই, সন্তুষ্ট হইলেন, এবং জীমূতবাহনকে শত শত সাধুবাদপ্রদান করিয়া কহিলেন, জগতে জীবমাত্রেই স্ব স্ব প্রাণরক্ষায় যত্নবান। কিন্তু, আপন প্ৰাণ দিয়া, পরের প্রাণরক্ষা করে, এরূপ ব্যক্তি অতি বিরল। যাহা হউক, আমি তোমার দয়া ও সাহস দর্শনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি; বরপ্রার্থনা কর।
জীমূতবাহন কহিলেন, খগেশ্বর। যদি প্রসন্ন হইয়া থাক, এই বর দাও, তুমি অতঃপর আর নাগহিংসা করিবে না; এবং, দীর্ঘ কাল ভক্ষণ করিয়া, যে অসংখ্য নাগের প্রাণসংহার করিয়াছ, তাহদেরও জীবনদান কর। গরুড়, তথাস্তু বলিয়া, তৎক্ষণাৎ পাতাল হইতে অমৃত আহরণপূর্বক, অস্থিস্তূপের উপর সেচন করিয়া, মৃত নাগগণের জীবনদান করিলেন, এবং জীমূতবাহনকে কহিলেন, রাজকুমার! আমার প্রসাদে, তোমাদের অপহৃত রাজ্যের পুনরুদ্ধার হইবেক। এইরূপ বরপ্রদান করিয়া, গরুড় অন্তহিত হইলে, শঙ্খচূড়ও জীমূতবাহনের বহুবিধ স্তুতি করিয়া, বিদায় লইয়া, স্বস্থানে প্রস্থান করিল।
জীমূতবাহন, এইরূপ বরলাভে চরিতার্থ হইয়া, পিতৃসমীপে উপস্থিত হইলেন; এবং, লোক দ্বারা, শ্বশুরালয়ে স্বীয় মঙ্গলসংবাদ পাঠাইয়া দিলেন। তাঁহাদের রাজ্যাপহারক জ্ঞাতিবর্গ, বরপ্রদানবৃত্তান্ত অবগত হইয়া, রাজা জীমূতকেতুর শরণাগত হইল; এবং, স্তুতি ও বিনতি দ্বারা প্রসন্ন করিয়া, তাহাকে রাজপদে পুনঃস্থাপিত করিল।
ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! জীমূতবাহন ও শঙ্খচূড়, এ উভয়ের মধ্যে কোন ব্যক্তির অধিক ভদ্রতাপ্রকাশ হইল। বিক্ৰমাদিত্য কহিলেন, শঙ্খচূড়ের। বেতাল কহিল, কি প্রকারে। রাজা কহিলেন, শঙ্খচূড়, জীমূতবাহনের প্রাণদান বিষয়ে, প্রথমতঃ কোনও মতে সম্মত হয় নাই; পরিশেষে, সম্মত হইয়াও, কাত্যায়নীর নিকটে গিয়া, উপকারকের মঙ্গলপ্রার্থনা করিতে লাগিল; এবং পুনরায় আসিয়া, প্রাণদানে উদ্যত হইয়া, জীমূতবাহনের প্রাণরক্ষা করিল। বেতাল কহিল, যে ব্যক্তি পরার্থে প্ৰাণদান করিল, তাহার। ভদ্রতা অধিক বলিয়া গণ্য হইল না কেন। রাজা কহিলেন, জীমূতবাহন ক্ষত্রিয়জাতি; ক্ষত্রিয়ের প্রাণত্যাগ অতি অকিঞ্চিৎকর জ্ঞান করে। অতএব, এই জীবনদান, জীমূতবাহনের পক্ষে, তাদৃশ দুষ্কর নহে।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।
১৬. ষোড়শ উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ!
চন্দ্ৰশেখর নগরে রত্নদত্ত নামে বণিক বাস করিত। তাহার উন্মাদিনী নামে পরম সুন্দরী কন্যা ছিল। সে বিবাহযোগ্য হইলে, তাহার পিতা, তত্ৰত্য নরপতির নিকটে গিয়া, নিবেদন করিল, মহারাজ! আমার এক সুরূপা কন্যা আছে; যদি আপনকার অভিরুচি হয়, গ্ৰহণ করুন; নতুবা, অন্য ব্যক্তিকে দিব।
রাজা, দুই তিন বয়োবৃদ্ধ প্রধান রাজপুরুষদিগকে, উন্মাদিনীর লক্ষণপরীক্ষার্থে, প্রেরণ করিলেন। তাঁহারা, রাজকীয় আদেশ অনুসারে, রত্নদত্তের আলয়ে উপস্থিত হইলেন; এবং, উন্মাদিনীকে ইন্দ্রের অপ্সরা অপেক্ষাও অধিকতর রূপবতী ও সর্বপ্রকারে সুলক্ষণ দেখিয়া, পরামর্শ করিলেন, এই কন্যা মহিষী হইলে, রাজা, ইহার নিতান্ত বশতাপন্ন হইয়া, এক বারেই রাজ্যচিন্তা পরিত্যাগ করিবেন। অতএব উত্তম কল্প এই, রাজার নিকটে কুরূপা ও কুলক্ষণা বলিয়া পরিচয় দেওয়া যাউক। অনন্তর, তাঁহারা রাজসমীপে পরামর্শানুরূপ সংবাদ দিলে, তিনি, তদীয় বাক্যে বিশ্বাস করিয়া, অস্বীকার করিলেন। তখন রত্নদত্ত, সৈন্যাধ্যক্ষ বলভদ্রবর্মার সহিত, আপনি কন্যার বিবাহ দিল।