এক ঋষিকুমারের সহিত, রাজকুমারের অতিশয় বন্ধুত্ব জন্মিল। এক দিন, দুই বন্ধুতে একত্র হইয়া ভ্ৰমণার্থে নিৰ্গত হইলেন। অনতিদূরে কাত্যায়নীর মন্দির ছিল; শ্রবণমনোহর বীণা শব্দ শ্রবণগোচর করিয়া, তাঁহারা, কৌতুকাবিষ্ট চিত্তে, সত্বর গমনে, তথায় উপস্থিত হইয়া, দেখিলেন, এক পরম সুন্দরী কন্যা, বীণানুগত স্তুতিগর্ভ গীত দ্বারা, ভগবতী কাত্যায়নীর উপাসনা করিতেছে। উভয়ে, একতানমন হইয়া, শ্রবণ ও দর্শন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, সেই কন্যা, জীমূতবাহনকে নয়নগোচর করিয়া, মনে মনে তাঁহাকে পতিত্বে বরণ, এবং স্বীয় সহচরী দ্বারা তাঁহার নাম, ধাম, ব্যবসায় প্রভৃতির পরিচয়গ্রহণপূর্বক, প্ৰস্থান করিল।
অনন্তর, তাহার সহচরী, তদীয় নির্দেশক্রমে, তাহার মাতার নিকট পূর্বাপর সমস্ত নিবেদন করিলে, তিনি স্বীয় পতি রাজা মলয়কেতুর নিকটে কন্যার অভিপ্রায় ব্যক্তি করিলেন। মলয়কেতু আপন পুত্র মিত্ৰা বসুকে কহিলেন, তোমার ভগিনী বিবাহযোগ্য হইয়াছে; আর নিশ্চিন্ত থাকা উচিত নহে; উপযুক্ত পাত্রের অন্বেষণ করা আবশ্যক। শুনিলাম, গন্ধৰ্বাধিপতি রাজা জীমূতকেতু, রাজ্যাধিকারপরিহারপূর্বক, নিজ পুত্ৰ জীমূতবাহন মাত্র সমভিব্যাহারে, মলয়াচলে অবস্থিতি করিতেছেন। আমার অভিপ্রায়, জীমূতবাহনকে কন্যাদান করি। তুমি, রাজা জীমূতকেতুর নিকটে গিয়া, আমার এই অভিপ্ৰায় তাহার গোচয় কর।
মিত্রাবসু, পিতার আদেশ অনুসারে, জীমূতকেতুর সমীপে উপস্থিত হইয়া, সবিশেষ সমস্ত বিজ্ঞাপন করিলে, তিনি তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন; এবং, জীমূতবাহনকে, মিত্রাবসুর সমভিব্যাহারে, মলয়কেতুর নিকটে পাঠাইয়া দিলেন। মলয়কেতু, শুভ লগ্নে, স্বীয় কন্যা মলয়াবতীর বিবাহকাৰ্য সম্পন্ন করিলেন। বর ও কন্যা, পরম সুখে, কালব্যাপন করিতে লাগিলেন।
এক দিন, জীমূতবাহন ও মিত্রাবসু, উভয়ে, মলয় মহীধরের পরিসরে, পরিভ্রমণবাসনায়, বাসস্থান হইতে বহির্গত হইলেন। ভূধরের উত্তর ভাগে উপস্থিত হইয়া, দূর হইতে এক শ্বেতবর্ণ বস্তুরাশি নয়নগোচর করিয়া, জীমূতবাহন মিত্রাবসুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, বয়স্য। গণ্ডশৈলের ন্যায়, ধবলবৰ্ণ, রাশীকৃত কি বস্তু দৃষ্ট হইতেছে। মিত্ৰাবসু কহিলেন, মিত্র। পূর্ব কালে, গরুড়ের সহিত, নাগগণের নিরন্তর ঘোরতর যুদ্ধ হইয়াছিল। কিয়ৎ কাল পরে, নাগেরা, সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইয়া, সন্ধিপ্রার্থনা করিলে, গরুড় কহিলেন, যদি তোমরা, আমার দৈনন্দিন আহারের নিমিত্ত, এক এক নাগ উপহার দিতে পার, তাহা হইলে আমি তোমাদের প্রার্থনায় সম্মত হই; নতুবা, অবিলম্বে নাগকুল নিঃশেষ করিব। নিরুপায় নাগেরা, তাহাতেই সন্মত হইল। তদবধি, প্রতিদিন, এক এক নাগ, পাতাল হইতে আসিয়া, ঐ স্থানে উপস্থিত থাকে; গরুড়, মধ্যাহ্নকালে আসিয়া, ভক্ষণ করেন। এইরূপে, ভক্ষিত নাগগণের অস্থি দ্বারা, ঐ পর্বতাকার ধবলরাশি প্রস্তুত হইয়াছে।
শ্রবণমাত্র, জীমূতবাহনের অন্তঃকরণ কারুণ্যরসে পরিপূর্ণ হইল। তখন তিনি মনে মনে বিবেচনা করিলেন, মধ্যাহ্নকাল আগতপ্ৰায়; অবশ্যই এক নাগ, গরুড়ের আহারার্থে, পৰ্যায়ক্রমে, উপস্থিত হইবেক; আমি, আপন প্ৰাণ দিয়া, তাহার প্রাণরক্ষা করিব। অনন্তর, কৌশলক্রমে শ্যালককে বিদায় করিয়া, ক্ৰমে ক্রমে অস্থিরাশির নিকটবর্তী হইয়া, জীমূতবাহন রোদনশব্দশ্রবণ করিলেন; এবং, সত্বর গমনে, রোদনস্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, এক বৃদ্ধা নাগী, শিরে করাঘাতপূর্বক, হাহাকার ও উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতেছে। দেখিয়া, একান্ত শোকাক্রান্ত হইয়া, তিনি কাতর বচনে নাগীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মা! তুমি কি নিমিত্তে রোদন করিতেছ। সে গরুড়বৃত্তান্তের বর্ণন করিয়া কহিল, অন্য আমার পুত্র শঙ্খচূড়ের বার; ক্ষণকাল পরেই, গরুড় আসিয়া, আহারার্থে তাহার প্রাণসংহার করিবেক। আমার দ্বিতীয় পুত্র নাই। আমি, সেই দুঃখে দুঃখিত হইয়া, রোদন করিতেছি। জীমূতবাহন কহিলেন, মা আর রোদন করিও না; আমি, আপন প্রাণ দিয়া, তোমার পুত্রের প্রাণরক্ষা করিব। নাগী কহিল, বৎস! তুমি, কি কারণে, পরের জন্যে প্রাণত্যাগ করিবে। আর, পরের পুত্রের প্রাণ দিয়া, আপন পুত্রের প্রাণরক্ষা করিলে, আমারও ঘোরতর অধৰ্ম ও যার পর নাই অপযশ হইবেক।
এইরূপে উভয়ের কথোপকথন হইতেছে, ইত্যবসরে শঙ্খচূড়ও তথায় উপস্থিত হইল; এবং, জীমূতবাহনের অভিসন্ধি শুনিয়া, তাহার পরিচয়গ্ৰহণপূর্বক, বিশেষজ্ঞ হইয়া কহিল, মহারাজ। আপনি অন্যায় আজ্ঞা করিতেছেন। বিবেচনা করিয়া দেখুন, আমার মত কত শত ব্যক্তি সংসারে জন্মিতেছে ও মরিতেছে; কিন্তু, আপনকার ন্যায় ধর্মাত্মা দয়ালু সংসারে সর্বদা জন্মগ্রহণ করেন না। অতএব, আমার পরিবর্তে, আপনকার প্রাণত্যাগ করা, কোনও ক্রমে, উচিত নহে। আপনি জীবিত থাকিলে, লক্ষ লক্ষ লোকের মহোপকার হইবেক। আমি জীবিত থাকিয়া, কোনও কালে, কাহারও কোনও উপকার করিতে পারিব না। মাদৃশ্য ব্যক্তির জীবন মরণ দুই তুল্য।
জীমূতবাহন কহিলেন, শুন শঙ্খচূড়। প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, আপন প্রাণ দিয়া, তোমার প্রাণরক্ষা করিব। আমি ক্ষত্ৰিয়কুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছি; ক্ষত্ৰিয়েরা, প্রতিজ্ঞাভঙ্গ অপেক্ষা, প্রাণত্যাগ অতি লঘু ও সহজ জ্ঞান করেন। বিশেষতঃ, প্ৰাণস্নেহে প্ৰতিজ্ঞাপ্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হইলে, নরকগামী হইতে হয়। অতএব, যখন স্বমুখে ব্যক্ত করিয়াছি, তখন অবশ্যই প্ৰাণ দিয়া, তোমার প্রাণরক্ষা করিব; তুমি স্বস্থানে প্রস্থান কর। এইরূপ বলিয়া, তিনি শঙ্খচূড়কে বিদায় করিলেন; এবং তদীয় প্রতিশীর্ষ হইয়া, গরুড়ের আগমনপ্রতীক্ষায়, নির্দ্দিষ্ট স্থানে উপবিষ্ট রহিলেন। শঙ্খচূড়, জীমূতবাহনের নির্বন্ধলঙ্ঘনে অসমর্থ হইয়া, বিষন্ন মনে, বিরস বদনে, মলয়াচলবাসিনী কাত্যায়নীর সম্মুখে উপস্থিত হইল; এবং, একাগ্ৰচিত্ত হইয়া, জীবনদাতা জীমূতবাহনের জীবনরক্ষণের উপায়প্রার্থনা করিতে লাগিল।