এদিকে, মনস্বী, ভূদেবের নিকটে গিয়া, পূর্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত বৰ্ণনা করিলে, তিনি অতিশয় প্রীত ও চমৎকৃত হইলেন; এবং, স্বীয় সহচর শশীকে বিংশতিবর্ষীয় পুত্ৰ সাজাইয়া, স্বয়ং, পূর্ববৎ বৃদ্ধবেশধারণপূর্বক, রাজসমীপে উপস্থিত হইলেন। রাজা, প্ৰণাম ও স্বাগত প্রশ্নপূর্বক বসিতে আসন দিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয়ের এত বিলম্ব হইল কেন। ভূদেব কহিলেন, মহারাজ! বিলম্বের কথা কেন জিজ্ঞাসা করেন। অনেক কষ্টে, অনেক অন্বেষণ করিয়া, পুত্ৰ পাইয়াছি। এক্ষণে, পুত্র ও পুত্ৰবধু লইয়া, গৃহে যাইব। রাজা, ব্ৰহ্মশাপভয়ে কম্পিত ও কৃতাঞ্জলি হইয়া, ব্ৰাহ্মণের নিকট সবিশেষ সমস্ত নিবেদন করিলেন।
ব্ৰাহ্মণ শুনিয়া কোপে কম্পমানকলেবর হইলেন, এবং শাপপ্রদানে উদ্যত হইয়া কহিলেন, তোমার এ কি ব্যবহার; আমি তোমাকে রাজা জানিয়া, বিশ্বাস করিয়া, তোমার হস্তে পুত্রবধূসমর্পণ করিয়াছিলাম। তুমি, আপনি ইষ্টসিদ্ধির নিমিত্ত, যথেচ্ছ বিনিয়োগে প্ৰবৃত্ত হইয়া, আমার সর্বনাশ করিয়াছ। বলিতে কি, কোনও কালে, আমার এ মনোবেদনা দূর হইবেক না। রাজা শুনিয়া যৎপরোনাস্তি ভীত হইলেন, এবং অশেষপ্রকার স্তুতি ও বিনীতি করিয়া কহিলেন, মহাশয়! কৃপা করিয়া আমায় ক্ষমা করিতে হইবেক; আপনকার যে অপকার করিয়াছি, তাহার প্রতিক্রিয়ার্থে, যে আজ্ঞা করিবেন, দ্বিরুক্তি না করিয়া, তাহাতেই সম্মত হইব। ভূদেব কহিলেন, যদি তুমি আমার পুত্রের সহিত আপন কন্যার বিবাহ দাও, তাহা হইলে, আমি কথঞ্চিৎ ক্ষমা করিতে পারি।
রাজা, ব্ৰহ্মকোপানলে কুলক্ষয়ভয়ে, তৎক্ষণাৎ তদীয় প্রস্তাবে সম্মত হইলেন; এবং, জ্যোতির্বিদ ব্ৰাহ্মণ দ্বারা, শুভ দিন ও শুভ লগ্ন নির্ধারিত করিয়া, ব্ৰাহ্মণতনয়ের সহিত কন্যার বিবাহ দিলেন। ভূদেব রাজকন্যা লইয়া আলয়ে উপস্থিত হইলে, শশী ও মনস্বী, উভয়ে, এই ভাৰ্য আমার আমার বলিয়া, পরস্পর বিষম বিবাদ আরব্ধ করিল। মনস্বী কহিল, আমি পূর্বে ইহার পাণিগ্রহণ করিয়াছি, এবং, আমার সহযোগে, ইহার গর্ভসঞ্চার হইয়াছে। শশী কহিলেন, রাজা সর্বসমক্ষে আমাকে কন্যাদান করিয়াছেন।
ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! এক্ষণে, এই কন্যা, শাস্ত্র ও যুক্তি অনুসারে, কাহার সহধর্মিণী হইতে পারে। বিক্রমাদিত্য কহিলেন, আমার মতে মনস্বীর। বেতাল কহিল, শাস্ত্ৰে লিখিত আছে, কন্যার দান, বিক্রয়, পরিত্যাগে পিতামাতার সম্পূর্ণ অধিকার। রাজা সর্ব সমক্ষে, ধর্ম সাক্ষী করিয়া, শশীকে কন্যা দান করিয়াছেন। অতএব, পিতৃদত্ত কন্যা শশীরই সহধর্মিণী হইতে পারে; তাহা না হইয়া, মনস্বীর কেন হইবেক, বল। রাজা কহিলেন, তুমি যাহা কহিতেছ, তাহার যথার্থতা বিষয়ে অণুমাত্ৰ সংশয় নাই। কিন্তু, মনস্বী পূর্বে বিবাহ করিয়াছে, এবং, তাহার সহযোগে, রাজকন্যার গর্ভসঞ্চার হইয়াছে। এমন স্থলে, সে মনস্বীর সহচারিণী হইলে, তাহারও সতীত্বরক্ষা হয়, ধর্মেরও মান থাকে।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।
১৫. পঞ্চদশ উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ!
ভারতবর্ষের উত্তর সীমায়, হিমালয় নামে, অতি প্ৰসিদ্ধ পৰ্বত আছে। তাহার প্রস্থদেশে, পুষ্পপুর নামে, পরম রমণীয় নগর ছিল। গন্ধৰ্বরাজ জীমূতকেতু ঐ নগরে রাজত্ব করিতেন। তিনি, পুত্ৰকামনা করিয়া, বহু কাল, কল্পবৃক্ষের আরাধনা করিয়াছিলেন। কল্পবৃক্ষ প্রসন্ন হইয়া বরপ্রদান করিলে, রাজা জীমূতকেতুর এক পুত্র জন্মিল। তিনি পুত্রের নাম জীমূতবাহন রাখিলেন। জীমূতবাহন, স্বভাবতঃ, সাতিশয় ধর্মশীল, দয়াবান, ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন; এবং, স্বল্প পরিশ্রমে, স্বল্পকাল মধ্যে, সর্ব শাস্ত্রে পারদর্শী ও শস্ত্রবিদ্যায় বিশারদ হইয়া উঠিলেন।
কিয়ৎ কাল পরে, রাজা জীমূতকেতু, পুনরায় কল্পবৃক্ষকে প্রসন্ন করিয়া, এই বরপ্রার্থনা করিলেন, আমার প্রজারা সর্বপ্রকার সম্পত্তিতে পরিপূর্ণ হউক। কল্পবৃক্ষের বরদান দ্বারা, তদীয় প্রজাবৰ্গ সর্বপ্রকার সম্পত্তিতে পরিপূর্ণ হইল, এবং ঐশ্বৰ্যমদে মত্ত হইয়া, রাজাকেও তৃণজ্ঞান করিতে লাগিল। ফলতঃ, অল্পকালমধ্যে, রাজা ও প্রজা বলিয়া, কোনও অংশে, কোনও বিশেষ রহিল না। তখন, জীমূতকেতুর জ্ঞাতিবর্গ গোপনে পরামর্শ করিল, ইহার পিতাপুত্রে, অনন্যমন ও অনন্যকর্ম হইয়া, দিবানিশি, কেবল ধর্মচিন্তায় কালযাপন করিতেছে; রাজ্যের দিকে ক্ষণমাত্রও দৃষ্টিপাত করে না। প্ৰজা সকল উচ্ছৃঙ্খল হইতে লাগিল। অতএব, ইহাদের উভয়কে রাজ্যচ্যুত করিয়া, যাহাতে উপযুক্তরূপ রাজ্যশাসন হয়, এরূপ ব্যবস্থা করা উচিত। অনন্তর, বহুতর সৈন্যসংগ্রহপূর্বক, তাহার রাজপুরীর চতুর্দিক নিরুদ্ধ করিল।
এই ব্যাপার দেখিয়া, যুবরাজ জীমূতবাহন পিতার নিকট নিবেদন করিলেন, মহারাজ! জ্ঞাতিবর্গ, একবাক্য হইয়া, আমাদিগকে রাজ্যচ্যুত করিবার অভিসন্ধিতে, এই উদ্যোগ করিয়াছে। আপনকার আজ্ঞা পাইলে, রণক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হইয়া, বিপক্ষপক্ষের সৈন্যক্ষয় ও সমুচিত দণ্ডবিধান করি।
জীমূতকেতু কহিলেন, এই ক্ষণভঙ্গুর পাঞ্চভৌতিক দেহ অতি অকিঞ্চিৎকর; বিনশ্বর রাজপদের নিমিত্ত, বহুসংখ্যক জীবের প্রাণহিংসা করিয়া, মহাপাপে লিপ্ত হওয়া উচিত নহে। ধর্মপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির, আত্মীয়গণের কুমন্ত্রণায়, কুরুক্ষেত্ৰযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া, পশ্চাৎ অনেক অনুতাপ করিয়াছিলেন। অতএব, রাজপদপরিত্যাগ করিয়া, কোনও নিভৃত স্থানে গিয়া, প্রশান্ত মনে, দেবতার আরাধনা করা ভাল। এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া, পিতাপুত্রে নগর হইতে বহির্গত হইলেন; এবং, মলয় পর্বতে গিয়া, তদীয় অধিত্যকায় কুটীরনির্মাণপূর্বক, তপস্যা করিতে লাগিলেন।