এইরূপে রাজকন্যার অভিপ্রায় বুঝিয়া, মনস্বী আনন্দপ্রবাহে মগ্ন হইল, এবং কহিল, প্ৰিয়সখি! আমি যদি তোমার প্ৰিয়সমাগম সম্পন্ন করিতে পারি, আমায় কি পারিতোষিক দাও। রাজকন্যা কহিলেন, সখি! অধিক আর কি বলিব, যদি তুমি তাঁহাকে মিলাইয়া দিতে পার, তোমার দাসী হইয়া, চিরকাল চরণসেবা করিব। মনস্বী, তৎক্ষণাৎ আপনি স্বরূপ প্রাপ্ত হইয়া, প্রিয়সম্ভাষণপূর্বক, রাজকুমারীর করগ্রহণ করিল। রাজকন্যা অসম্ভাবিত প্ৰিয়সমাগম দ্বারা, মনোরথনদীর পার প্রাপ্ত হইয়া, প্রথমতঃ, বাকপথাতীত হর্ষ, বিস্ময়, লজ্জার উদ্রেক সহকারে, পরম রমণীয় অনিৰ্বাচনীয় দশান্তর প্রাপ্ত হইলেন; অনন্তর, লজ্জাভঙ্গ হইলে, মনস্বীর রূপান্তরপ্রতিপত্তিরূপ অদ্ভুত ব্যাপারের নিগৃঢ় তত্ত্ব জানিবার জন্য, একান্ত কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া, সবিশেষ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। সে, আপন বিচেতনদশা অবধি, ভূদেবের তিরস্করণী বিদ্যাপ্রদান পর্যন্ত, আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত রাজকন্যার গোচর করিয়া, গান্ধৰ্ব বিধানে তাঁহার পাণিগ্রহণ করিল।
কিছু দিনের পর, রাজকুমারী অন্তর্বত্নী হইলেন। এই সময়ে, এক দিন, রাজা সুবিচার সপরিবার অমাত্যভবনে নিমন্ত্রিত হইলেন। রাজকন্যা, এক নিমিষের নিমিত্তেও, ব্রাহ্মণবধূকে নয়নের বহির্বর্তিনী করিতেন না; সুতরাং, তিনি অমাত্যভবনপ্রস্থানকালে, তাহারে সমভিব্যাহারে লইয়া গেলেন। অমাত্যপুত্র, ব্ৰাহ্মণবধুর অসামান্য রূপলাবণ্য দর্শনে, মোহিত হইল; এবং, নিতান্ত অধৈৰ্য হইয়া, আপনি মিত্রের নিকটে কহিল, যদি এই স্ত্রীরত্ন হস্তগত না হয়, প্ৰাণত্যাগ করিব। ফলতঃ, ক্ৰমে ক্ৰমে, মন্ত্রিপুত্রের বিরহবেদনা এরূপ বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, যে কেবল দশমী দশা মাত্র অবশিষ্ট রহিল।
তখন তাহার মিত্র, অন্য কোনও উপায় না দেখিয়া, অমাত্যের নিকটে গিয়া, তদীয় অবস্থা ও প্রার্থনা জানাইল। আমাত্য, অপত্যস্নেহের আতিশয্যবশতঃ, উচিতানুচিতবিবেচনায় বিসর্জন দিয়া, রাজসমীপে সবিশেষ সমস্ত নির্দেশপূর্বক, ব্রাহ্মণবধূপ্রাপ্তির প্রার্থনা জানাইলেন। রাজা শুনিয়া অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইলেন এবং কহিলেন, আরে মুর্খ! স্থাপিত ধন, স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে, অন্যকে দেওয়া সৰ্বতোভাবে অতি গৰ্হিত কর্ম। বিশেষতঃ, ব্ৰাহ্মণ, কোনও কালে, কোনও ক্রমে, ব্যতিক্রমের আশঙ্কা নাই জানিয়া, বিশ্বাস করিয়া, আমার হস্তে পুত্রবধূসমৰ্পণ করিয়া গিয়াছেন। বিশ্বাসভঙ্গ, শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে, যার পর নাই, গর্হিত ব্যবহার। আমি, তোমার অনুরোধে, এইরূপ দুষ্ক্রিয়ায়, প্ৰাণান্তেও, প্ৰবৃত্ত হইতে পারিব না। মন্ত্রী শুনিয়া, নিরাশ হইয়া, গৃহে প্ৰতিগমন করিলেন; কিন্তু পুত্রের তাদৃশী দশা দর্শনে, নিতান্ত কাতর হইয়া, আহার নিদ্রা পরিহারপূর্বক, বিষাদসাগরে মগ্ন হইলেন।
সর্বাধিকারী, ক্রমে ক্রমে, পুত্রের তুল্য দশা প্রাপ্ত হইলে, রাজকাৰ্যব্যাঘাতের উপক্রম দেখিয়া, অন্যান্য প্রধান রাজপুরুষেরা রাজার নিকটে নিবেদন করিলেন, মহারাজ! মন্ত্রিপুত্রের যাদৃশী অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহাতে তাহার জীবনরক্ষা হওয়া কঠিন। যেরূপ দেখিতেছি, তাহার কোনও অমঙ্গল ঘটিলে, মন্ত্রীও অবধারিত প্ৰাণত্যাগ করিবেন। এরূপ সর্বাংশে কর্মদক্ষ কার্যসহায় দ্বিতীয় ব্যক্তি নাই; সুতরাং, রাজকাৰ্যনিৰ্বাহবিষয়ে বিষম বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবেক। অতএব, আমরা বিনয়বাক্যে প্রার্থনা করিতেছি, বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণের পুত্রবধূকে অমাত্যপুত্রের নিকট প্রেরিত করুন। বহুদিন হইল, ব্ৰাহ্মণের উদ্দেশ নাই; আর তাঁহার আসিবার সম্ভাবনা, কোনও ক্রমে, বোধগম্য হইতেছে না; যদিও কালান্তরে প্রত্যাগমন করেন; ব্ৰাহ্মণজাতি সাতিশয় অর্থলোভী; বহুসংখ্যক অর্থ দিয়া, তুষ্ট করিয়া, অনায়াসে বিদায় করিতে পারিবেন; অথবা, কন্যান্তরসঙ্ঘাটন করিয়া, তাহার পুত্রের বিবাহ দিয়াও তাঁহাকে তুষ্ট করিতে পারা যাইবেক।
রাজা, নিতান্ত নিরুপায় ভাবিয়া, অবশেষে, ব্ৰাহ্মণবধুর নিকটে গিয়া, মন্ত্রিপুত্রের প্রার্থনা জানাইলেন। কপটাচারী বধুবেশধারী মনস্বী নিবেদন করিল, মহারাজ! আপনি দেশাধিপতি; আপনকার ইচ্ছা, সর্ব কাল, সর্ব বিষয়ে, সর্বাংশে বলবতী; বিশেষতঃ, এক্ষণে আমি আপনকার আশ্রয়ে আছি; আপনকার আজ্ঞাপ্ৰতিপালন, আমার পক্ষে, সর্বতোভাবে, সম্পূর্ণ উচিত কর্ম। কিন্তু মহারাজ! বিবেচনা করুন, আমি বিবাহিতা নারী; বিবাহিতা নারীর পুরুষান্তরসেবা-শঙ্কুনিষিদ্ধ ও লোকাচারবিরুদ্ধ। আপনি দণ্ডধারী হইয়া, কি রূপে, ঈদৃশ বিসদৃশ আজ্ঞা করিতেছেন, বুঝিতে পারিতেছি না। মহারাজ! আমি, প্ৰাণান্তেও পরপুরুষের মুখ দেখিব না। রাজা শুনিয়া, নিরতিশয় বিষন্ন, হতবুদ্ধি, ও কিংকৰ্তব্যবিমূঢ় হইয়া, অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইলেন।
মনস্বী, আর এখানে থাকায় ভদ্রস্থতা নাই, অতঃপর পলায়ন করাই সর্বাংশে শ্ৰেয়ঃ, এই স্থির করিয়া, বধূবেশপরিত্যাগপূর্বক, কৌশলক্রমে, রাজবাটী হইতে পলায়ন করিল। রাজা, ব্ৰাহ্মণবধূর অদর্শনবৃত্তান্ত অবগত হইয়া, এক বারে বিষাদপারাবারে মগ্ন হইলেন, এবং ভাবিতে লাগিলেন, এ আবার এক বিষম সর্বনাশ উপস্থিত হইল; ব্ৰাহ্মণ আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলে, কি উত্তর দিব; ব্ৰাহ্মণবধুর নিকট ও রূপ অনুচিত প্ৰস্তাব করাই অতি অসঙ্গত কর্ম হইয়াছে। যদৰ্থে প্রার্থনা করিলাম, তাহাও সিদ্ধ হইল না; অথচ ঘোরতর বিপদে পড়িলাম।