মনস্বী মন্ত্রবলে ষোড়শবর্ষীয়া কন্যা হইল। ভূদেব অশীতিবর্ষদেশীয়ের আকারধারণ করিলেন, এবং, মনস্বীকে বধুবেশধারণ করাইয়া, রাজা সুবিচারের নিকটে উপস্থিত হইলেন। রাজা, বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণ দর্শনমাত্র, গাত্ৰোখান করিয়া, প্ৰণামপূর্বক, বসিতে আসন প্ৰদান করিলেন।
ব্ৰাহ্মণ, আসনপরিগ্রহ করিয়া, আশীৰ্বাদ করিলেন, যিনি, এই জগম্মণ্ডল প্ৰলয়জলধিজলে নিলীন হইলে, মীন রূপধারণ করিয়া, ধৰ্মমূল অপৌরুষেয় বেদের রক্ষা করিয়াছেন; যিনি, বরাহমূর্তি পরিগ্রহ করিয়া, বিশাল দশনাগ্রভাগ দ্বারা, প্ৰলয়জলনিমগ্ন মেদিনীমণ্ডলের উদ্ধার করিয়াছেন; যিনি, কুৰ্মরূপ অবলম্বন করিয়া, পৃষ্ঠে এই সসাগরা ধরা ধারণ করিয়া আছেন; যিনি, নৃসিংহের আকারস্বীকার করিয়া, নখকুলিশপ্রহার দ্বারা বিষম শত্রু হিরণ্যকশিপুর বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ করিয়াছেন; যিনি, দৈত্যরাজ বলিকে ছলিবার নিমিত্ত, বামন অবতার হইয়া, দেবরাজকে পুনৰ্বার ত্ৰিলোকীর ইন্দ্ৰত্বপদে সংস্থাপিত করিয়াছেন; যিনি, জমদগ্নির ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়া, পিতৃবধামর্ষে প্ৰদীপ্ত হইয়া, তীক্ষ্নধার কুঠার দ্বারা, মহাবীৰ্য কার্তবীৰ্য অর্জুনের ভুজবনচ্ছেদন করিয়াছেন, এবং, একবিংশতি বার পৃথ্বীকে নিঃক্ষত্রিয়া করিয়া, অরতিশোণিতজলে পিতৃতৰ্পণ করিয়াছেন; যিনি, দেবতাগণের অভ্যর্থনা অনুসারে, দশরথ গৃহে অংশচতুষ্টয়ে অবতীর্ণ হইয়া, বানর সৈন্য সমভিব্যাহারে, সমুদ্রে সেতুবন্ধনপূর্বক, দুর্বৃত্ত দশাননের বংশধ্বংস করিয়াছেন; যিনি, দ্বাপরযুগের অন্তে, ধর্মসংস্থাপনার্থে, যদুবংশে অংশে অবতীর্ণ হইয়া, দৈত্যবধ দ্বারা ভূমির ভার হরিয়া, অশেষপ্রকার লীলা করিয়াছেন; যিনি, বেদমাৰ্গবিপ্লাবনের নিমিত্ত, বুদ্ধাবতার হইয়া, দয়ালুত্ব, জিতেন্দ্ৰিয়ত্ব প্রভৃতি সদগুণের পরা কাষ্ঠা প্ৰদৰ্শিত করিয়াছেন; যিনি, সম্ভল গ্রামে বিষ্ণুযশানামক ধর্মনিষ্ঠ ব্ৰহ্মপরায়ণ ব্ৰাহ্মণের ভবনে অবতীর্ণ হইয়া, ভুবনমণ্ডলে কল্কী নামে বিখ্যাত হইবেন, এবং, অতি দ্রুতগামী দেবদত্ত তুরঙ্গমে আরোহণ করিয়া, করতলে করাল করবাল ধারণপূর্বক, বেদবিদ্বেষী, ধৰ্মমার্গপরিভ্রষ্ট, নষ্টমতি দুরাচারদিগের সমুচিত দণ্ডবিধান করিবেন; সেই ত্রিলোকীনাথ, বৈকুণ্ঠস্বামী, ভূতভাবন ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।
রাজা জিজ্ঞাসিলেন, মহাশয়! কোথা হইতে আসিতেছেন। বৃদ্ধবেশী ভূদেব কহিলেন, মহারাজ! আমি গঙ্গার পূর্বপার হইতে আসিতেছি। ইনি আমার পুত্রবধু। ইহাকে ইহার পিত্ৰালয় হইতে আনিতে গিয়াছিলাম; প্রত্যাগমন করিয়া দেখিলাম, মারীভয়ে গ্রামস্থ সমস্ত লোক, স্থানত্যাগ করিয়া, দেশান্তরে প্রস্থান করিয়াছে। গৃহে ব্ৰাহ্মণী ও বিংশতিবর্ষীয় পুত্র রাখিয়া গিয়াছিলাম; তাহারাও, সেই উপদ্রবের সময়, দেশত্যাগ করিয়াছে; কোথায় গিয়াছে, কিছুই অনুসন্ধান করিতে পারি নাই। জানি না, কত স্থানে ভ্ৰমণ করিলে, কত কালে, তাহাদিগকে দেখিতে পাইব। তাহাদের অদর্শনে, দুঃসহ শোকভারে আক্রান্ত হইয়া, এক বারে, আমি আহার ও নিদ্রায় বিসর্জন দিয়াছি। এক্ষণে মানস করিয়াছি, পুত্রবধূকে বিশ্বস্তহস্তে ন্যস্ত করিয়া, তাহাদের অন্বেষণে নিৰ্গত হইব। আপনি দেশাধিপতি; আপনকার ন্যায় প্রকৃত বিশ্বাসভাজন কোথায় পাইব। আপনি, অনুগ্ৰহ করিয়া, আমার প্রত্যাগমন পর্যন্ত, পুত্রবধুটিকে আপনকার আশ্রয়ে রাখুন।
রাজা শুনিয়া মনে মনে বিবেচনা করিলেন, পরকীয় মহিলা গৃহে রাখা অতি কঠিন কর্ম; কিন্তু, অস্বীকার করিলে, ব্ৰাহ্মণ মনঃক্ষুন্ন হইবেন; অতএব, চন্দ্ৰপ্ৰভার নিকটে দিয়া, তাহার উপর ইহার রক্ষণাবেক্ষণের ভার দি। এই ব্যবস্থা স্থির করিয়া, তিনি ব্ৰাহ্মণকে কহিলেন, মহাশয়! আপনি যে আজ্ঞা করিতেছেন, তাহাতে আমি সম্মত হইলাম। ভূদেব, হৃষ্টচিত্তে আশীৰ্বাদপ্রয়োগপূর্বক, রাজার হস্তে পুত্রবধু ন্যস্ত করিয়া, প্রস্থান করিলেন। রাজাও, অনতিবিলম্বে অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া, কন্যার হস্তে কন্যাবেশধারী মনস্বীর ভারসমৰ্পণ করিলেন। রাজকন্যা, ব্ৰাহ্মণবধূকে সমবয়স্ক দেখিয়া, আদরপূর্বক, তাহার ভার লইলেন, এবং, স্বীয় সহোদরার ন্যায়, যত্ন ও স্নেহ করিতে লাগিলেন। সর্বদা একত্র উপবেশন, একত্র ভোজন, এক শয্যায় শয়ন আদি দ্বারা, পরস্পর প্রণয়সঞ্চার হইতে লাগিল। মনস্বী, ক্ৰমে ক্রমে, রাজকন্যার প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় হইয়া উঠিল। এক দিবস, সে, রাজকন্যার মনের ভাবপরীক্ষার্থে, কথাপ্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করিল, প্ৰিয়সখি। তুমি দিবানিশি কি চিন্তা কর, এবং, কি নিমিত্তে, দিন দিন দুর্বল হইতেছে, বল।
রাজপুত্ৰী কহিলেন, সখি! বসন্তকালে, এক দিন, সখীগণ সঙ্গে লইয়া, বনবিহারে গিয়াছিলাম। তথায়, দৈবযোগে, এক পরম সুন্দর যুবা ব্ৰাহ্মণকুমার আমার নয়নপথের পথিক হইলেন। তদবধি তদাসক্তচিত্ত হইয়া, তদ্বিরহে দিন দিন এরূপ দুর্বল হইতেছি। দুঃসহ বিরহানল, ক্রমে প্রবল হইয়া, নিরন্তর অন্তরদাহ করিতেছে। আমার আহার, বিহার, শয়ন, উপবেশন, কোনও বিষয়েই সুখ নাই। দিবানিশি কেবল সেই মোহিনী মূর্তির চিন্তা করিয়া, প্রাণধারণ করিতেছি, এবং চতুর্দিক তন্ময় দেখিতেছি। তাঁহার নাম ধাম কিছুই জানি না। ভাবিয়া চিন্তিয়া, কোনও উপায় স্থির করিতে পারি নাই। নিতান্ত নির্লজ্জা হইয়া, কাহারও নিকট মনের বেদনা ব্যক্ত করিতে পারি না। তুমি আমার দ্বিতীয় প্ৰাণ; তোমার কাছে কোনও কথাই গোপনীয় নাই। তুমি কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করিলে, তাহাতেই প্ৰকাশ করিলাম। ফলতঃ, তোমার নিকটে মনের বেদনা ব্যক্ত করিয়াও, অনেক অংশে, স্বাস্থ্যলাভ হইল। তুমি এ বিষয় অতি গোপনে রাখিবে।