বণিককন্যা, চোরের মৃত্যুসংবাদ পাইবামাত্র, সহগমনের উদ্যোগ করিয়া, বধ্যভূমিতে উপস্থিত হইল; এবং, যথানিয়মে চিতা প্রস্তুত হইলে, চোরকে, শূল হইতে অবতীর্ণ করিয়া, গাঢ় আলিঙ্গনপূর্বক, তাহারে লইয়া মৃত্যুশয্যায় শয়ন করিল।
দাহিকেরা অগ্নিপ্রদানে উদ্যত হইল। নিকটে ভগবতী কাত্যায়নী দেবীর মন্দির ছিল। দেবী, তথা হইতে নির্গমনপূর্বক, শ্মশানভূমিতে উপস্থিত হইলেন, এবং কহিলেন। বৎসে! বরপ্রার্থনা কর; তোমার সাহস ও সতীত্ব দর্শনে সবিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছি। শোভনা কহিল, জননি! যদি প্ৰসন্ন হইয়া থাক, এই চোরের জীবনদান কর। দেবী, তথাস্তু বলিয়া, তৎক্ষণাৎ পাতাল হইতে অমৃত আনয়নপূর্বক, চোরর প্রাণদান করিলেন।
ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! চোর, কি নিমিত্তে, প্রথমে হাস্য ও পরে রোদন করিয়াছিল, বল। রাজা কহিলেন, চোর, কন্যার কামনা শুনিয়া, আমার মৃত্যুসময়ে ইহার অনুরাগ সঞ্চার হইল; ভগবানের কি ইচ্ছা, কিছুই বুঝা যায় না; এই আলোচনা করিয়া, প্ৰথমে হাস্য করিয়াছিল; অনন্তর, এই কন্যা, আমার নিমিত্তে, রাজাকে সর্বস্ব দিতে উদ্যত হইয়াছিল; আমি ইহার এমন কি উপকারে আসিতাম; এই অনুশোচনা করিয়া, দুঃখিত হৃদয়ে রোদন করিল।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।
১৪. চতুর্দশ উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ!
কুসুমবতী নগরীতে সুবিচার নামে রাজা ছিলেন। তাহার, চন্দ্ৰপ্ৰভা নামে, অবিবাহিতা দুহিতা ছিল। রমণীয় বসন্তকাল উপস্থিত হইলে, রাজকুমারী, উপবনবিহারে অভিলাষিণী হইয়া, পিতার অনুমতিপ্রার্থনা করিলেন। রাজা সম্মত হইলেন; এবং রাজধানীর অনতিদূরে, যে যোজনবিস্তৃত অতি রমণীয় উপবন ছিল, উহাকে স্ত্রীলোকের বাসোপযোগী করিবার নিমিত্ত, বহুসংখ্যক লোক পাঠাইয়া দিলেন। তাহারা তথায় উপস্থিত হইবার পূর্বে, বিংশতিবর্ষবয়স্ক, অতি রূপবান, মনস্বী নামে, বিদেশীয় ব্ৰাহ্মণকুমার, পরিশ্রান্ত ও আতপক্লান্ত হইয়া, উপবনমধ্যবর্তী নিকুঞ্জমধ্যে প্রবেশপূর্বক, স্নিগ্ধ ছায়াতে নিদ্রাগত ছিল। রাজপরিচারকেরা, তথায় উপস্থিত হইয়া, আবশ্যক কাৰ্য সকল সম্পন্ন করিয়া, প্ৰস্থান করিল। দৈবযোগে, ঐ ব্ৰাহ্মণকুমার তাহাদের দৃষ্টিপথে পতিত হইল না।
রাজকুমারী, স্বীয় সহচরীবর্গ ও পরিচারিকাগণের সহিত, উপবনে উপস্থিত হইয়া, ইতস্ততঃ ভ্ৰমণ করিতে করিতে, ব্ৰাহ্মণকুমারের সমীপবৰ্তিনী হইলেন। ভ্রমণকারিণীদিগের পদশব্দে, মনস্বীরও নিদ্রাভঙ্গ হইল। ব্ৰাহ্মণকুমারের ও রাজকুমারীর চারি চক্ষুঃ একত্র হইলে, ব্ৰাহ্মণকুমার মোহিত ও মূৰ্ছিত হইয়া ভূতলে পড়িল; রাজকুমারীও, আবিস্তৃত সাত্ত্বিক ভাবের প্রভাবে, কম্পমানকলেবরা ও বিকলিতচিত্ত হইলেন। সখীগণ, অকস্মাৎ ঈদৃশ অতিবিষম বিষমস্মিরদশা উপস্থিত দেখিয়া, মনুষ্যবাহী যানে আরোহণ করাইয়া, তৎক্ষণাৎ রাজকুমারীকে গৃহে লইয়া গেল। ব্ৰাহ্মণকুমার, সেই স্থানেই, স্পন্দহীন পতিত রহিল।
শশী ও ভূদেব নামে দুই ব্ৰাহ্মণ, কামরূপে বিদ্যাশিক্ষা করিয়া, স্বদেশে প্রতি গমন করিতেছিলেন। তাঁহারাও, আতপে তাপিত হইয়া, বিশ্রামার্থে, উপবনস্থ নিকুঞ্জমধ্যে উপস্থিত হইলেন। প্রবেশমাত্র, সেই ব্ৰাহ্মণকুমারকে তদাবস্থা পতিত দেখিয়া, ভূদেব স্বীয় সহচরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, বল দেখি, শশী! এ এরূপ অচেতন হইয়া পতিত আছে কেন। শশী কহিলেন, বোধ করি, কোনও নায়িকা ভ্রূচাপ দ্বারা কটাক্ষবাণ নিক্ষিপ্ত করিয়াছে, তাহাতেই এরূপে পতিত আছে। ভূদেব কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া কহিলেন, ইহাকে জাগরিত করিয়া, সবিশেষ জিজ্ঞাসা করা আবশ্যক।
অনন্তর, ভূদেব, শশীর নিষেধ না মানিয়া, নানাবিধ উপায় দ্বারা, ব্ৰাহ্মণকুমারের চৈতন্য সম্পাদনা করিলেন, এবং জিজ্ঞাসিলেন, অহে ব্ৰাহ্মণতনয়! কি কারণে তোমার ঈদৃশী দশা ঘটিয়াছে, বল। ব্ৰাহ্মণকুমার কহিল, যে ব্যক্তি দুঃখ দূর করিতে ইচ্ছা ও সমৰ্থ, তাহার নিকটেই দুঃখের কথা ব্যক্ত করা উচিত; নতুবা, যার তার কাছে বলিয়া বেড়াইলে, মূঢ়তামাত্র প্রকাশ পায়। ভূদেব কহিলেন, ভাল, তুমি আমার নিকটে ব্যক্ত কর; আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, যে রূপে পারি, তোমার দুঃখ দূর করিব। মনস্বী কহিল, কিয়ৎ ক্ষণ পূর্বে, এক রাজকন্যা এই উপবনে ভ্রমণ করিতে আসিয়াছিল; তাহাকে দেখিয়া, আমার এই অবস্থা ঘাটিয়াছে। অধিক আর কি বলিব, প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছি, তাহাকে না পাইলে, প্রাণত্যাগ করিব।
তখন ভূদেব কহিলেন, তুমি আমার সমভিব্যাহারে চল; যাহাতে তোমার মনোরথ সিদ্ধ হয়, সে বিষয়ে অশেষবিধ যত্ন করিব। আর, যদি তোমার প্রাৰ্থিত সম্পাদনে নিতান্তই কৃতকাৰ্য হইতে না পারি, অন্ততঃ, বহুসংখ্যক অর্থ দিয়া বিদায় করিব। মনস্বী কহিল, যদি আমার অভিপ্রেত স্ত্রীরত্নলাভের সদুপায় করিতে পার, তবেই তোমাদের সঙ্গে যাই; নতুবা, ধনের নিমিত্তে, আমার কিছুমাত্র স্পৃহা নাই। ভূদেব, মনস্বীর এই বাক্য শ্ৰবণগোচর করিয়া, ঈষৎ হাস্য করিলেন; এবং, অবশ্যই তোমার মনোরথ সম্পন্ন করিব, তুমি আমাদের সমভিব্যাহারে চল; এই বলিয়া, আপন আলয়ে লইয়া গেলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া, তিনি তাহাকে এক একাক্ষর মন্ত্র শিখাইয়া দিলেন; বলিলেন, এই মন্ত্রের উচ্চারণ করিলে, তুমি ষোড়শবর্ষীয়া কন্যার আকৃতি ধারণ করিবে, এবং, ইচ্ছা করিলেই, পুনর্বার আপনি স্বরূপ প্রাপ্ত হইবে।