ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসিল, মহারাজ! কি কারণে, অমাত্য প্ৰাণত্যাগ করিলেন, বল। বিক্রমাদিত্য কহিলেন, মন্ত্রী বিবেচনা করিলেন, রাজা বিষয়ারসে আসক্ত হইয়া, রাজ্যচিন্তায় জলাঞ্জলি দিলেন; প্ৰজা অনাথ হইল। অতঃপর, আর কোনও ব্যক্তি আমার প্রতি সমুচিত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিবেক না। অহোরাত্র এই বিষম চিন্তাবিষ শরীরে প্রবিষ্ট হওয়াতে, সত্যপ্রকাশের প্রাণবিয়োগ হইল।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।
১২. দ্বাদশ উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ!
চূড়াপুরে, দেবস্বামী নামে, এক ব্ৰাহ্মণ বাস করিতেন। তিনি রূপে রতিপতি, বিদ্যায় বৃহস্পতি, সম্পদে ধনপতি ছিলেন। কিয়ৎ দিন পরে, দেবস্বামী, লাবণ্যবতী নামে, এক গুণবতী ব্ৰাহ্মণতনয়ার পাণিগ্রহণ করিলেন। ঐ কন্যা রূপলাবণ্যে ভুবনবিখ্যাত ছিল। উভয়ে প্ৰণয়ে কালব্যাপন করিতে লাগিলেন।
একদা বিপ্রদম্পতী, গ্রীষ্মের প্রাদুর্ভাবপ্রযুক্ত, অট্টালিকার উপরিভাগে শয়ন করিয়া, নিদ্রা যাইতেছিলেন। সেই সময়ে, এক গন্ধৰ্ব, বিমানে আরোহণপূর্বক, আকাশপথে ভ্ৰমণ করিতেছিল। দৈবযোগে, বিপ্রকামিনীর উপর দৃষ্টিপাত হওয়াতে, সে তদীয় অলৌকিক রূপলাবণ্যদর্শনে মোহিত হইল; এবং, বিমান কিঞ্চিৎ অবতীর্ণ করিয়া, নিদ্রান্বিতা লাবণ্যবতীকে লইয়া পলায়ন করিল।
কিয়ৎ ক্ষণ বিলম্বে নিদ্রাভঙ্গ হইলে, দেবস্বামী, স্বীয় প্রেসয়ীকে পার্শ্বশায়িনী না দেখিয়া, অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া, ইতস্ততঃ অন্বেষণ করিতে লাগিলেন; কিন্তু কোনও সন্ধান না পাইয়া, সাতিশয় বিষন্ন ভাবে, নিশাযাপন করিলেন। পর দিন, প্ৰভাত হইবামাত্র, তিনি, অতিমাত্র ব্যগ্র ও চিন্তাকুল চিত্তে, পুনরায়, বিশেষ করিয়া, অশেষপ্রকার অনুসন্ধান করিলেন; পরিশেষে, নিতান্ত নিরাশ্বাস ও উন্মত্তপ্রায় হইয়া, সংসারাশ্রমে বিসর্জন দিয়া, সন্ন্যাসীর বেশে দেশে দেশে ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন।
এক দিন, দেবস্বামী, দিবা দ্বিপ্রহরের সময়, অতিশয় ক্ষুধার্ত হইয়া, এক ব্ৰাহ্মণের আলয়ে অতিথি হইলেন; কহিলেন, আমি ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর হইয়াছি; কিছু ভোজনীয় দ্রব্য দিয়া, আমার প্রাণরক্ষা কর। গৃহস্থ ব্ৰাহ্মণ, তৎক্ষণাৎ এক পাত্ৰ দুগ্ধে পরিপূর্ণ করিয়া, অতিথি ব্ৰাহ্মণের হস্তে অৰ্পণ করিলেন। গ্রহবৈগুণ্যবশতঃ, ইতঃপূর্বে, এক কৃষ্ণসৰ্প ঐ দুগ্ধে মুখাৰ্পণ করাতে, তাহা অতিশয় বিষাক্ত হইয়াছিল। পান করিবামাত্র, সেই বিষ, সৰ্বাঙ্গব্যাপী হইয়া, অতিথি ব্ৰাহ্মণকে ক্রমে ক্রমে অবসন্ন ও অচেতন করিতে লাগিল। তখন তিনি গৃহস্থ ব্ৰাহ্মণকে, তুমি বিষভক্ষণ করাইয়া ব্ৰহ্মহত্যা করিলে, এই বলিয়া ভূতলে পড়িলেন ও প্রাণত্যাগ করিলেন। ব্রাহ্মণ, অকস্মাৎ ব্ৰহ্মহত্যা দেখিয়া, যার পর নাই বিষন্ন হইলেন; এবং বাটীর মধ্যে প্ৰবেশিয়া, আপন পত্নীকে, তুই দুগ্ধে বিষ মিশ্ৰিত করিয়া রাখিয়াছিলি, তাহাতেই ব্ৰহ্মহত্যা হইল; তুই অতি দুর্বৃত্তা, আর তোর মুখাবলোকন করিব না; ইত্যাদি নানাপ্রকার তিরস্কার ও বহু প্ৰহার করিয়া, গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন।
ইহা কহিয়া, বেতাল বিক্ৰমাদিত্যকে জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! এ স্থলে কোন ব্যক্তি দোষভাগী হইবেক। রাজা কহিলেন, সৰ্পের মুখে স্বভাবতঃ বিষ থাকে; সুতরাং, সে দোষী হইতে পারে না; গৃহস্থ ব্ৰাহ্মণ ও তাঁহার ব্ৰাহ্মণী, সেই দুগ্ধকে বিষাক্ত বলিয়া জানিতেন না; সুতরাং, তাঁহারাও ব্ৰহ্মহত্যাপাপে লিপ্ত হইবেন না; আর, অতিথি ব্ৰাহ্মণ, সবিশেষ না জানিয়া, পান করিয়াছেন; এজন্য, তিনিও আত্মঘাতী নহেন। কিন্তু, গৃহস্থ ব্ৰাহ্মণ, সবিশেষ অনুসন্ধান না করিয়া, নিরপরাধ সহধর্মিণীকে গৃহ হইতে বহিস্কৃত করিলেন, তাহাতে তিনি, অকারণে পত্নীপরিত্যাগজন্য, দুরদৃষ্টভাগী হইবেন।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।
১৩. ত্ৰয়োদশ উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ!
চন্দ্ৰহৃদয় নগরে, রণধীর নামে, প্ৰবলপ্ৰতাপ নরপতি ছিলেন। রাজা রণধীরের প্রভাবে, প্ৰজারা চিরকাল নিরুপদ্রবে। বাস করিত। কিয়ৎ দিন পরে, নগরে গুরুতর চৌৰ্যক্রিয়ার আরম্ভ হইল। পৌরেরা, চৌরের উপদ্রবে অতিশয় ব্যতিব্যস্ত হইয়া, সকলে মিলিয়া, নৃপতিসমীপে স্ব স্ব দুঃখের পরিচয় প্ৰদান করিল। রাজা সবিশেষ সমস্ত শ্রবণগোচর করিয়া কহিলেন, যাহা হইয়াছে, তাহারা আর উপায় নাই; অতঃপর যাহাতে না হইতে পায়, সে বিষয়ে সবিশেষ যত্নবান থাকিলাম। এইরূপ আশ্বাস দিয়া, রাজা নগরবাসীদিগকে বিদায় করিলেন; এবং, নূতন নূতন প্রহরী নিযুক্ত করিয়া, তাহাদিগকে সাতিশয় সতর্কতাপূর্বক নগররক্ষার আদেশ দিয়া, স্থানে স্থানে পাঠাইলেন; বলিয়া দিলেন, চোর পাইলে তাহার প্রাণদণ্ড করিবে। প্রহরীরা, সাতিশয় সাবধান হইয়া, নগররক্ষা করিতে লাগিল; তথাপি চৌর্যের কিঞ্চিম্মাত্র নিবৃত্তি হইল না, বরং দিনে দিনে বৃদ্ধিই হইতে লাগিল।
পুরবাসীরা, পুনরায় একত্র হইয়া, রাজার নিকটে গিয়া, আপনি আপনি দুঃখ জানাইলে, তিনি তাহাদিগকে কহিলেন, এক্ষণে তোমরা বিদায় হও; আদ্য রজনীতে, আমি স্বয়ং নগররক্ষার্থে নির্গত হইব। প্রজারা, রাজাজ্ঞা অনুসারে, স্বীয় স্বীয় আলয়ে গমন করিল। রাজাও, সায়ংকাল উপস্থিত হইলে, অসি, চর্ম, ও বর্ম ধারণপূর্বক, একাকী নগররক্ষার্থে নির্গত হইলেন; এবং, কিয়ৎ দূরে গিয়া, এক অপরিচিত ব্যক্তিকে সম্মুখে দেখিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কে, কোথায় যাইতেছ, তোমার বাস কোথায়। সে কহিল, আমি চোর; তুমি কে, কি নিমিত্তে আমার পরিচয় লইতেছ, বল। রাজা ছল করিয়া বলিলেন, আমিও চোর। তখন সে অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া কহিল, আইস, উভয়ে একত্র হইয়া চুরি করিতে যাই। রাজা সন্মত হইলেন।