রাজা শ্রবণমাত্র, অতিমাত্র কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া, পুনর্বার সত্যপ্রকাশের হস্তে রাজ্যের ভারপ্রদানপূর্বক, সেতুবন্ধ রামেশ্বরে উপস্থিত হইলেন। নিরূপিত সময়ে, মহাদেবের পূজা করিয়া, মন্দির হইতে বহির্গত হইবামাত্র, সত্যপ্রকাশের বর্ণনানুরূপ ভুরুহ মহীপতির নয়নগোচর হইল। তাঁহার উল্লিখিত সৰ্বাঙ্গসুন্দরী কামিনীর সৌন্দৰ্যসন্দর্শনে ও সঙ্গীতশ্রবণে, বিমূঢ় ও পূর্বাপরপর্যালোচনাপরিশূন্য হইয়া, রাজা অর্ণবপ্রবাহে লম্ফপ্রদানপূর্বক, অল্পক্ষণমধ্যে, ঐ বৃক্ষে আরোহণ করিলেন। বৃক্ষও, মহীপতি সহিত, তৎক্ষণাৎ পাতালপুরে প্রবিষ্ট হইল।
অনন্তর, সেই রমণী রাজার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, অহে বীরপুরুষ! তুমি কে, কি অভিপ্ৰায়ে এ স্থানে আগমন করিলে, বল। তিনি কহিলেন, আমি পুণাপুরের রাজা; আমার নাম বল্লভ; তোমার সৌন্দর্য ও সৌকুমাৰ্য দর্শনে মুগ্ধ হইয়া আসিয়াছি। এই কথা শুনিয়া, সেই রমণী কহিল, আমি তোমার সাহসে সন্তুষ্ট হইয়াছি। যদি তুমি, কেবল কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে, আমার সহিত সর্ব প্রকারে সম্পর্কশূন্য হইতে পার, তাহা হইলে, আমি তোমার সহধর্মিণী হই। রাজা শুনিয়া, আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইয়া, তৎক্ষণাৎ তদীয় প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। তৎপরে সে রাজাকে, এই নিয়মের রক্ষার্থে, পুনরায় প্রতিজ্ঞাপাশে বদ্ধ করিয়া, গান্ধৰ্ব বিধানে আপন প্ৰতিজ্ঞ সম্পন্ন করিল। রাজা, নব মহিষীর সহিত, পরম কৌতুকে, কালব্যাপন করিতে লাগিলেন।
কৃষ্ণ চতুর্দশী উপস্থিত হইল। রাজমহিষী, সাতিশয় আগ্রহ ও নিরতিশয় ব্যগ্রতা প্রদর্শনপূর্বক, নিকটে থাকিতে নিষেধ করিলে, রাজা, পূর্বকৃত প্রতিজ্ঞা অনুসারে, তৎক্ষণাৎ তথা হইতে অপসৃত হইলেন। কিন্তু, কি কারণে পূর্বে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করিয়াছিল, এবং এক্ষণে, এতাদৃশ আগ্রহ ও ব্যগ্রতা প্রদর্শনপূর্বক, পুনর্বার নিষেধ করিল, যাবৎ ইহা সবিশেষ অবগত না হইব, তাবৎ আমার অন্তঃকরণে এক বিষম সংশয় থাকিবেক। অতএব, ইহার তথ্যানুসন্ধান করা আবশ্যক। এই বলিয়া, কৌতুহলাকুলিত চিত্তে, অন্তরালে থাকিয়া, রাজা অবলোকন করিতে লাগিলেন।
অর্ধারাত্র সময়ে, এক রাক্ষস আসিয়া কন্যার অঙ্গে করার্পণ করিল। রাজা দেখিয়া, একান্ত অসহমান হইয়া, করতলে করাল করবাল ধারণপূর্বক, তৎক্ষণাৎ তথায় উপস্থিত হইলেন, এবং অশেষপ্রকার তিরস্কার করিয়া কহিলেন, আরো দুরাচার রাক্ষস! তুই, আমার সমক্ষে, প্ৰিয়তমার অঙ্গে হস্তার্পণ করিস না। যাবৎ তোরে না দেখিয়াছিলাম, তাবৎ অন্তঃকরণে ভয় ছিল; এক্ষণে দেখিয়া নিৰ্ভয় হইয়াছি, এবং তোর প্রাণদণ্ড করিতে আসিয়াছি। এই বলিয়া, তিনি খড়্গপ্রহার দ্বারা তাহার শিরশ্চেদন করিলেন। তখন রাজমহিষী, অকৃত্রিম পরিতোষপ্রদর্শনপূর্বক, কহিলেন, তুমি, দুর্দান্ত রাক্ষসের হস্ত হইতে মুক্ত করিয়া, আমায় জীবনদান করিলে। আমি, এত কাল, কি যন্ত্রণাভোগ করিয়াছি, বলিতে পারি না।
রাজা জিজ্ঞাসিলেন, সুন্দরি। কি কারণে তুমি, এতাবৎ কাল পর্যন্ত, এই দারুণ দৈবদুর্বিপাকে পতিত ছিলে, বল।
তিনি কহিলেন, মহারাজ! শ্রবণ কর। আমি বিদ্যাধর নামক গন্ধৰ্বরাজের কন্যা; আমার নাম রত্নমঞ্জরী। ভোজনকালে আমি নিকটে উপবিষ্ট না থাকিলে, পিতার তৃপ্তি হইত না; এজন্য, নিত্যই, ভোজনসময়ে তাহার সন্নিহিত থাকিতাম। এক দিন, বাল্য খেলায় আসক্ত হইয়া, ভোজনবেলায় গৃহে উপস্থিত ছিলাম না। পিতা, আমার অপেক্ষায়, বুভূক্ষায় অভিভূত হইয়া, ক্ৰোধাভরে এই শাপ দিলেন, অদ্যাবধি তুমি রসাতলবাসিনী হইবে; এবং কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে এক রাক্ষস আসিয়া তোমায় অশেষ প্রকারে যন্ত্রণা দিবে। আমি শুনিয়া অত্যন্ত কাতর হইলাম, এবং, পিতার চরণে ধরিয়া, বহুবিধ স্তুতি ও বিনীতি করিয়া, নিবেদন করিলাম, পিতঃ! আমার দুরদৃষ্টবশতঃ, সামান্য অপরাধে, উৎকট দণ্ডবিধান করিলেন। এক্ষণে, কৃপা করিয়া, শাপমোচনের কোনও উপায় করিয়া দেন; নতুবা, কত কাল যন্ত্রণাভোগ করিব। ইহা কহিয়া, আমি, বিষন্ন বদনে, রোদন করিতে লাগিলাম। তখন তিনি, পূর্বার্জিত স্নেহরসের সহায়তা দ্বারা, আমার বিনয়ের বশীভূত হইয়া কহিলেন, এক মহাবল পরাক্রান্ত বীরপুরুষ আসিয়া, সেই রাক্ষসের প্রাণদণ্ড করিয়া, তোমার শাপমোচন করিবেন। আমি, সেই শাপে, এই পাপে আশ্লিষ্ট ছিলাম। বহু দিনের পর, তুমি আমায় মুক্ত করিলে। এক্ষণে, অনুমতি কর, পিতৃদর্শনে যাই।
রাজা কহিলেন, যদি তুমি উপকার স্বীকার কর, অগ্রে একবার আমার রাজধানীতে চল; পরে পিতৃদর্শনে যাইবে। রত্নমঞ্জরী, মহোপকারকের নিকট অবশ্য কর্তব্য কৃতজ্ঞতাস্বীকারের অন্যথাভাবে অধৰ্ম জানিয়া, রাজার প্রার্থনায় সম্মত হইলে, তিনি, তাহারে সমভিব্যাহারে লইয়া, রাজধানীতে উপস্থিত হইলেন; এবং, কিছু দিন, তদীয় সহবাসে বিষয়রসে কালব্যাপন করিয়া, পরিশেষে, নিতান্ত অনিচ্ছাপূর্বক, তাহাকে পিতৃদর্শনে যাইতে অনুমতি দিলেন। তখন রত্নমঞ্জরী কহিলেন, মহারাজ। বহু কাল মনুস্যসহবাস দ্বারা, আমার গন্ধৰ্বত্ব গিয়াছে; এখন, সর্বতোভাবে, মনুষ্যভাবাপন্ন হইয়াছি। পিতা আমার সর্বগন্ধৰ্বপতি; এক্ষণে, তাহার নিকটে গিয়া, সমুচিত সমাদর পাইব না। অতএব, আর আমার তথায় যাইতে অভিলাষ নাই; তোমার নিকটেই যাবজ্জীবন অবস্থিতি করিব। রাজা শুনিয়া অতিশয় হর্ষ প্রাপ্ত হইলেন; এবং, রাজকাৰ্যে এককালে জলাঞ্জলি দিয়া, দিন যামিনী, সেই কামিনীর সহিত, বিষয়বাসনায় কালযাপন করিতে লাগিলেন। এই সমস্ত ব্যাপার দেখিয়া, প্রধান অমাত্য সত্যপ্ৰকাশ প্ৰাণত্যাগ করিলেন।