ঈদৃশ অশেষবিধ উপদেশ দ্বারা, অভয়চন্দ্ৰ বৌদ্ধধর্মে রাজার এরূপ শ্রদ্ধা ও অনুরাগ জন্মাইল যে, যে ব্যক্তি, তাঁহার সমক্ষে, ঐ ধর্মের প্রশংসা করিত, সে অশেষ প্রকারে রাজপ্ৰসাদভাজন হইত। ফলতঃ, রাজা, সবিশেষ অনুরাগ ও ভক্তিযোগ সহকারে, স্বীয় অধিকারে, অবলম্বিত অভিনব ধর্মের বহুল প্রচার করিলেন।
কালক্রমে রাজার লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে, তাহার পুত্র ধর্মধ্বজ পৈতৃক সিংহাসনে অধিরোহণ করিলেন। তিনি, সনাতন বেদশাস্ত্রের অনুবর্তী হইয়া, বৌদ্ধদিগের যথোচিত তিরস্কার ও নানাপ্রকার দণ্ড করিতে লাগিলেন; পিতার প্ৰিয়পাত্ৰ প্ৰধান মন্ত্রীকে, শিরোমুণ্ডনপূর্বক, গর্দভে আরোহণ ও নগর প্রদক্ষিণ করাইয়া, দেশবহিস্কৃত করিলেন; এবং, বৌদ্ধধর্মের সমূলে উন্মূলন করিয়া, বেদবিহিত সনাতন ধর্মের পুনঃস্থাপনে অশেষপ্রকার যত্ন ও প্রয়াস করিতে লাগিলেন।
কিয়ৎ দিন পরে, ঋতুরাজ বসন্তের সমাগমে, রাজা ধৰ্মধ্বজ, মহিষীত্রিয় সমভিব্যাহারে, উপবনবিহারে গমন করিলেন। সেই উপবনে এক সুশোভন সরোবর ছিল। রাজা, তাহাতে কমল সকল প্রফুল্প দেখিয়া, স্বয়ং জলে অবতরণপূর্বক, কতিপয় পুষ্প লইয়া, তীরে আসিয়া, এক মহিষীর হস্তে দিলেন। দৈবযোগে, একটি পদ্ম, মহিষীর হস্ত হইতে স্থলিত হইয়া, তদীয় বাম পদে পতিত হওয়াতে, উহার আঘাতে তাহার সেই পদ ভগ্ন হইল। তখন রাজা, হা হতোহস্মি বলিয়া, অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া, প্রতীকারচেষ্টা করিতে লাগিলেন। সায়ংকাল উপস্থিত হইল। সুধাকরের উদয় হইবামাত্র, তদীয় অমৃতময় শীতল কিরণমালার স্পর্শে, দ্বিতীয়া মহিষীর গাত্ৰ স্থানে স্থানে দগ্ধ হইয়া গেল। আর, তৎকালে অকস্মাৎ এক গৃহস্থের ভবনে উদূখলের শব্দ হইল; সেই শব্দ শ্রবণবিবরে প্রবিষ্ট হইবামাত্র, তৃতীয়া মহিষীর শিরোবেদনা ও মূর্ছা হইল।
ইহা কহিয়া বেতাল জিজ্ঞাসিল, মহারাজ! উহাদের মধ্যে কোন-কামিনী অধিক সুকুমারী। রাজা কহিলেন, সুধাকর করম্পর্শে যে রাজমহিষীর দেহ দগ্ধ হইল, আমার মতে, সেই সৰ্বাপেক্ষা সুকুমারী।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।
১১. একাদশ উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ!
পুণ্যপুর নগরে, বল্লভ নামে, নিরতিশয় প্রজাবল্লভ নরপতি ছিলেন। তাঁহার অমাত্যের নাম সত্যপ্রকাশ। এক দিবস, রাজা সত্যপ্রকাশের নিকট কহিলেন, দেখ, যে ব্যক্তি, রাজ্যেশ্বর হইয়া, অভিলাষানুরূপ বিষয়ভোগ না করে, তাহার রাজ্য ক্লেশপ্ৰপঞ্চ মাত্র। অতএব, অদ্যাবধি, আমি ইচ্ছানুরূপ বৈষয়িক সুখসম্ভোগে প্ৰবৃত্ত হইব; তুমি, কিয়ৎ কালের নিমিত্তে, সমস্ত রাজকার্যের ভার গ্রহণ করিয়া, আমায় এক বারে অবসর দাও। ইহা কহিয়া, অমাত্যহস্তে সমস্ত সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ ভারার্পণ করিয়া, রাজা, অনন্যমন ও অনন্যকর্ম হইয়া, কেবল ভোগসুখে কালব্যাপন করিতে লাগিলেন। সত্যপ্রকাশ, অগত্যা, রাজকীয় প্রস্তাবে সম্মত হইলেন; কিন্তু, স্বতন্ত্র রাজতন্ত্রনির্বাহ ও অহর্নিশ দুরবগাহ নীতিশাস্ত্রের অবিশ্রান্ত পর্যালোচনা দ্বারা, একান্ত ক্লান্ত হইতে লাগিলেন।
এক দিবস, অমাত্য আপন ভবনে, উৎকণ্ঠিত মনে, নির্জনে বসিয়া আছেন; এমন সময়ে, তাহার গৃহলক্ষ্মী লক্ষ্মীনাম্নী পত্নী তথায় উপস্থিত হইলেন, এবং, স্বামীকে সাতিশয় অবসন্ন ও নিরতিশয় দুর্ভাবনাগ্ৰস্ত দেখিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, এখন, কি নিমিত্তে, তোমায় সতত উৎকণ্ঠিত দেখিতে পাই, এবং, কি নিমিত্তেই বা, তুমি দিন দিন দুর্বল হইতেছ। তিনি কহিলেন, রাজা, আমার উপর সমস্ত বিষয়ের সম্পূর্ণ ভার দিয়া, নিশ্চিন্ত হইয়া, ভোগসুখে কালযাপন করিতেছেন। তদীয় আদেশ অনুসারে, ইদানীং, আমায় রাজশাসন ও প্ৰজাপালন সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় সম্পন্ন করিতে হইতেছে। রাজ্যের নানাবিষয়ক বিষম চিন্তা দ্বারা, আমি এরূপ দুর্বল হইতেছি। তখন তাঁহার পত্নী কহিলেন, তুমি, অনেক দিন, একাকী সমস্ত রাজকাৰ্য নিম্পন্ন করিলে; এক্ষণে, কিছু দিনের অবকাশ লইয়া, নিশ্চিন্ত হইয়া, তীৰ্থপৰ্যটন কর।
সত্যপ্রকাশ, সহধর্মিণীর উপদেশ অনুসারে, নৃপতিসমীপে বিদায় লইয়া, তীৰ্থপৰ্যটনে প্ৰস্থান করিলেন। তিনি, ক্ৰমে ক্রমে, নানা স্থানের তীর্থদর্শন করিয়া, পরিশেষে, সেতুবন্ধ রামেশ্বরে উপস্থিত হইলেন। তথায় তিনি, রামচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত দেবাদিদেব মহাদেবের মন্দিরে প্রবেশপূর্বক, দর্শনাদি করিয়া, নির্গত হইলেন; এবং, সমুদ্রে দৃষ্টিপাতমাত্র, দেখিতে পাইলেন, প্রবাহমধ্য হইতে এক অদ্ভুত স্বর্ণময় মহীরুহ বহির্গত হইল। ঐ মহীরুহের শাখায় উপবিষ্ট হইয়া, এক পরম সুন্দরী পূর্ণযৌবনা কামিনী, হস্তে বীণা লইয়া, মধুর, কোমল, তানলয়বিশুদ্ধ স্বরে, সঙ্গীত করিতেছে। সত্যপ্রকাশ, বিস্ময়াবিষ্ট ও অনন্যদৃষ্টি হইয়া, নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, ঐ অদ্ভুত মহীরুহ প্রবাহগর্ভে বিলীন হইল।
ঈদৃশ অঘটন ঘটনা নিরীক্ষণে চমৎকৃত হইয়া, সত্যপ্রকাশ, ত্বরায় স্বদেশে প্ৰতিগমনপূর্বক, নরপতিগোচরে উপস্থিত হইলেন, এবং কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন, মহারাজ। আমি এক অদৃষ্টচর, অশ্রুতপূর্ব আশ্চর্য দর্শন করিয়াছি; কিন্তু, বৰ্ণন করিলে, তাহাতে, কোনও প্রকারে, আপনকার বিশ্বাস জন্মাইতে পারিব না। প্রাচীন পণ্ডিতেরা কহিয়াছেন, যাহা কাহারও বুদ্ধিগম্য ও বিশ্বাসযোগ্য না হয়, তাদৃশ্য বিষয়ের কদাপি নির্দেশ করিবেক না; করিলে কেবল উপহাসাম্পদ হইতে হয়। কিন্তু, মহারাজ! আমি স্বচক্ষে প্ৰত্যক্ষ করিয়াছি; এই নিমিত্ত নিবেদন করিতেছি, যে স্থানে ত্রেতাবতার ভগবান রামচন্দ্ৰ, দুর্বৃত্ত দশাননের বংশধ্বংসবিধানবাসনায়, মহাকায় মহাবল কপিবল সাহায্যে, শতযোজনাবিস্তীর্ণ অর্ণবের উপর, লোকাতীত কীর্তিহেতু সেতুসঙ্ঘটন করিয়াছিলেন, তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, কল্লোলিনীবল্লাভের প্রবাহমধ্য হইতে, অকস্মাৎ এক স্বর্ণময় ভুরুহ বিনির্গত হইল; তদুপরি এক পরম সুন্দরী রমণী, বীণাবাদনপূর্বক, মধুর স্বরে সঙ্গীত করিতেছে। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, সেই বৃক্ষ কন্যা সহিত জলে মগ্ন হইয়া গেল। এই অদ্ভুত ব্যাপার দর্শনে বিস্ময়সাগরে মগ্ন হইয়া, তীৰ্থপৰ্যটন পরিত্যাগপূর্বক, আমি আপনকার নিকট ঐ বিষয়ের সংবাদ দিতে আসিয়াছি।